মুরাদ হোসেন, মাগুরা প্রতিনিধি
মাগুরার মহম্মদপুরের বাবুখালী ইউনিয়নের কেড়িনগর গ্রামের আকরাম মোল্যার মেয়ে কলেজছাত্রী আকলিমা খাতুন আঁখির শরীরে অগ্নিদ্বগ্ধের ঘটনায় নানা রহস্য ও ধ্রুমজালের সৃষ্টি হয়েছে। প্রেম, বিয়ে, তালাক অতঃপর একই গ্রামের পূর্বের প্রেমিক স্বামী নাজমুল হাসানের সাথে নতুন করে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হওয়ার জেরে পরিবার থেকে আঁখিকে অন্যত্র বিয়ের চাপ প্রয়োগ করলে সে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে মেয়ের পরিবারের দাবি পূর্বের স্বামীসহ তার লোকজন আঁখিকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে। গত ১৫ আগস্ট শনিবার সন্ধ্যায় বাড়ির জরাজীর্ণ ল্যাট্রিনের সামনে থেকে আঁখিকে অগ্নিদ্বগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে মাগুরা, অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। আকলিমা খাতুন আঁখি মহম্মদপুর কাজী সালিমা হক মহিলা কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। এ ঘটনায় আঁখির দাদা রতন মোল্যা বাদী হয়ে মহম্মদপুর থানায় ৭ জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেন। এরই মধ্যে পুলিশ ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে। অন্য দু’জন পলাতক রয়েছেন। উপজেলার কেড়িনগর গ্রামে গতকাল রোববার অনুসন্ধানে গেলে বেরিয়ে আসে নানা তথ্য ও রহস্য। স্থানীয় কেড়িনগর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে আকরাম মোল্যার মেয়ে আকলিমা খাতুন আঁখির সাথে প্রতিবেশি মাসুদ রানার ছেলে নাজমুল হাসানের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই সম্পর্কের সূত্র ধরে তারা এসএসসি পরীক্ষার আগেই ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ মাগুরা নোটারি পাবলিক কার্যালয়ে বিয়ে করে। বিয়ের পর আঁখি শ^শুরবাড়িতে চলে যায়। বিষয়টি আঁখির পরিবার মেনে নিতে পারেনি। সেই থেকে দুই পরিবারের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। তবে আঁখি তার স্বামীর সাথে ঘর সংসার করতে থাকে। দেড় বছর ঘর সংসারের পর ২০১৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আঁখি মাগুরা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে তার স্বামী নাজমুলকে তালাক প্রদান করে। স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, পরিবারের চাপের মুখে আঁখি তার প্রেমিক স্বামী নাজমুলকে তালাক দিতে বাধ্য হয়। এরপর আঁখিকে শ্রীপুর উপজেলার বরিশাট গ্রামে তার খালার বাড়িতে রাখা হয় এবং ভর্তি করা হয় শ্রীপুরের একটি স্কুলে। তালাক প্রদানের পরও আকলিমা খাতুন আঁখির সাথে তার পূর্বের স্বামী নাজমুলের আবার যোগাযোগ শুরু হয়। রক্ত ও কলম দিয়ে লেখা চিঠিপত্র আদান-প্রদান, মোবাইল ফোনে কথাবার্তা ছাড়াও সরাসরি দেখাও হতো তাদের মধ্যে। ফের তাদের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি এলাকায় জানাজানিও হয়। স্থানীয় রফিক মোল্যা জানান, তালাকের পর আঁখি এবং নাজমুলের মধ্যে আবারো প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক ও যোগাযোগ শুরু হয়। তিনি আঁখিকে নতুন করে নাজমুলের সাথে বিয়ের কথা বললে মেয়ের পরিবার তা প্রত্যাখান করে দেয় বলেও জানান রফিক মোল্যা। গত ১৪ আগস্ট পরিবার থেকে আঁখিকে অন্যত্র বিয়ের কথা বললে সে রাজি না হওয়ায় তাকে মারধর করা হয় বলেও জানা যায়। পরদিন ১৫ আগস্ট বিকেলে আঁখির পিতা ও মাতা ধূলজোড়া তাদের এক আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যান বলা হয়। তবে তারা আঁখির বিয়ের জন্য ছেলে দেখতে গিয়েছিলেন বলেও এলাকায় চাউর আছে। এদিন সন্ধ্যায় জরাজীর্ণ ল্যাট্রিনে যাওয়ার কিছু সময় পর আঁখির চিৎকারে তার বৃদ্ধ দাদা রতন মোল্যা ছুটে গিয়ে দেখতে পান তার নাতনির গায়ে আগুন জ¦লছে। এ সময় তিনিও চিৎকার করলে আশপাশের লোকজনও ছুটে আসেন। আঁখির গায়ের আগুন নিভিয়ে উঠানে আনা হয়। এরপর অগ্নিদ্বগ্ধ আঁখিকে মাগুরা হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় সেখান থেকে তাকে ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। আঁখির দাদা রতন মোল্যার বলেন, আমার নাতনির হাত-পা বেঁধে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে নাজমুলসহ তার লোকজন এমন অভিযোগ করলেও তিনি ঘটনাস্থল থেকে কাউকে পালিয়ে যেতে দেখেননি। আঁখির শরীরের আগুন নেভাতে আসা প্রতিবেশি শারমিন খাতুন জানায়, কিভাবে আঁখির শরীরে আগুন লেগেছে তা জানিনা। ঘটনাস্থল আঁখিদের ল্যাট্রিনের অবস্থা, অবস্থান এবং চারপাশ ঘুরে দেখলে অনেক রহস্য আর প্রশ্ন যে কারো মনে উদয় হবে। আগুন লাগানোর আগে আঁখির হাত-পা বাঁধার সময় এবং তার গায়ে কেরোসিন ঢালার সময় সে কেনো চিৎকার করলো না? আগুনে পোড়ার আগ পর্যন্ত সে চুপ করেইবা থাকলো কেনো? এই দুইটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতেই নানান রহস্য সামনে চলে আসে। আঁখির এই করুণদশার জন্য স্থানীয় অনেকেই তার পরিবারের সদস্যদের দিকেই আঙ্গুল তুলছেন। আকলিমা খাতুন আঁখির অমত থাকা সত্ত্বেও অন্যত্র বিয়ে করার জন্য রাজি হতে পরিবারের সদস্যরা তার উপর চাপ দিতে থাকে। অব্যাহত চাপ সইতে না পেরে তাদের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয় অনেকে। তবে মেয়ে পক্ষের লোকজন তাদের দাবি ও অভিযোগের জায়গাতে অনড়। তবে ঘটনার গভীরে অনুসন্ধান করলেই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত রহস্য। এলাকার অধিকাংশ মানুষ সেই দাবি জানিয়েছেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য ইসমাইল মৃধা বলেন, অগ্নিগ্ধের ঘটনাটি অনেকের কাছেই রহস্যজনক। নাজমুল হাসানের মা শাহানাজ পারভীন বলেন, প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে ন্যায় বিচারের স্বার্থে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এ বিষয়ে মহম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তারক বিশ^াস বলেন, প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছেও ঘটনাটি রহস্যজনক মনে হয়েছে। ঘটনার গভীরে গিয়ে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যাতে কোনো নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তিনি আরো বলেন, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। ৫ জনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।