নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে লিফট দুর্ঘটনা। সারা দেশে এক বছরের ব্যবধানে লিফট দুর্ঘটনা প্রায় ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। এ ধরনের দুর্ঘটনায় গত তিন বছরে ১৭ জন প্রাণ হারান এবং ৬৩৩ জন আহত হয়। নগরায়ণে বর্তমানে দেশজুড়েই বহুতল ভবন গড়ে ওঠছে। বাড়ছে লিফটের ব্যবহার। সাধারণত লিফটের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল থাকে ২০ বছর। তবে রক্ষণাবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে কোনো কোনো লিফট ২৫ বছর পর্যন্তও নিরাপদ সেবা দেয়। তারপর লিফট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বর্তমানে শুধু সরকারি ভবনই নয়, অনেক বেসরকারি ভবনের লিফটও রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতিতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তবে নিয়মিত পরিদর্শন ও দক্ষ জনবল তৈরির মাধ্যমে লিফট দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ব্যবহারকারী, নগর বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, লিফটের নির্ধারিত আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেলে ব্যবহারকালে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে থাকে। সেন্সর ত্রুটি থেকে তার ছিঁড়ে পড়ার মতো ঝুঁকিও তৈরি হয়। সাধারণ আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া লিফটগুলো রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি হলে আরো বেড়ে যায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি। এ ধরনের লিফট ব্যবহারের আগে নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা জরুরি। পাশাপাশি লিফটের যথাযথ ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষ জনবল প্রয়োজন। দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সীমিত প্রশিক্ষণ দিয়েই লিফট রক্ষণাবেক্ষণে লোক নিয়োগ করা হয়, নিরাপদ লিফট পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তা যথেষ্ট নয়। ওসব কারণেই লিফট দুর্ঘটনা বাড়ছে। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ২০২৪ সালে দেশে সর্বোচ্চ লিফট দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওই বছরের প্রথম ১০ মাসে সারা দেশে ২০৮টি লিফট দুর্ঘটনা ঘটে। তাতে নিহত হয় ৬ জন ও ১৯৯ জন আহত হয়। আর ২০২৩ সালে ১৭৪টি লিফট দুর্ঘটনায় ৯ জন প্রাণ হারায়। তিন বছরের মধ্যে লিফট দুর্ঘটনায় ওই বছরেই সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তাছাড়া ২০২২ সালে ১৮৯টি লিফট দুর্ঘটনায় দুজন নিহত ও ২৫২ জন আহত হয়।
সূত্র জানায়, সরকারি দফতর পরিসংখ্যান ভবনে বর্তমানে মোট ছয়টি লিফট রয়েছে। ১৯৯৯ সালে আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনের উদ্বোধন হয়। আর এ ভবনে ভবন নির্মাণের সময় ওসব লিফট স্থাপন করা হয়। শিন্ডলার ব্র্যান্ডের লিফটগুলোর বয়স এখন ২৫ বছরের বেশি।
ব্যবহারকারীরা জানান, ওই ভবনের ছয়টির মধ্যে কেবল ৩ নম্বর লিফটটি ঠিকভাবে কাজ করছে। পুরনো হয়ে যাওয়ায় অন্যগুলো ধীরগতিতে চলে এবং প্রায়ই আটকে যায়। তার মধ্যে পুরোপুরি অচল ৫ নম্বর লিফটটি। আর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) লিফটগুলো বেহাল অবস্থায়। হাসপাতালের জরুরি ও ক্যাজুয়ালটি বিভাগের দুটি লিফটের মধ্যে একটি সচল, অন্যটি বন্ধ। তাছাড়া গত বছরের ১২ মে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লিফটে আটকা পড়ে মমতাজ নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার কয়েকদিন আগে ৩ মে চিকিৎসা নিতে আসা জিল্লুর রহমান নামে এক রোগী হাসপাতালের ১২ তলায় লিফটের পাশের ফাঁক দিয়ে পড়ে নিহত হন। ২০২৩ সালের ৬ জানুয়ারি মানিকগঞ্জ সেন্ট্রাল স্পেশালাইজড হাসপাতালের লিফটের তার ছিঁড়ে ৭ জন আহত হয়েছিলেন। গত ২৭ মে সরকারি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) ভবনে এক লিফট দুর্ঘটনায় ৯ জন আহত হন। ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।
এদিকে এ বিষয়ে নগর প্রকৌশলীদের মতে, একটি লিফটের কার্যকর সময়কাল নির্ভর করে বহুলাংশে তার ধরন, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারের ওপর। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে একটি ভালো ব্র্যান্ডের লিফট ২০-২৫ বছর পর্যন্ত সচল ও কার্যকর থাকে। তবে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে এর আয়ুষ্কাল ৩০-৩৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। লিফটের দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে নিয়মিত ও পেশাদারি রক্ষণাবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। লিফটের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের আয়ুষ্কাল ভিন্ন হওয়ায় নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে ক্ষয়প্রাপ্ত অংশগুলো সময়মতো পরিবর্তন করা জরুরি।
অন্যদিকে এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিসের মুখপাত্র মো. শাহজাহান শিকদার জানান, আয়ুষ্কাল পেরিয়ে যাওয়া এবং সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দেশে লিফট দুর্ঘটনা বাড়ছে। লিফট রক্ষণাবেক্ষণে অনেক ক্ষেত্রে মানহীন সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে লিফটের সঠিক গ্রিজিংটা (দঁড়িতে গ্রিজ করা) খুব জরুরি। পাশাপাশি লিফটের গিয়ার শিফটিং ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণও খুব জরুরি। কিন্তু নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহারের ফলে লিফটে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়। পাশাপাশি লিফট পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করা প্রয়োজন। তাছাড়া কারিগরি সক্ষমতাসম্পন্ন প্রকৌশলীদের দিয়ে নিয়মিত লিফট পরিদর্শন করাতে হবে এবং পরিদর্শন শেষে একটি রেজিস্টারে লিফটের হালনাগাদ তথ্য লিপিবদ্ধ করতে হবে।