দীপক সরকার, বগুড়া প্রতিনিধি:
সারা বিশে^ দাপিয়ে বেড়ানো প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের দুঃশাসন এখন দুনিয়ার প্রায় সবগুলো দেশেই। এই ভাইরাসের প্রভাবের কাছে সারা দুনিয়া যেন অসহায় হয়ে পড়েছে। জীবন-জীবিকা, যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা পুরো অর্থনৈতিক সেক্টরকে স্থবির করে ফেলেছে এই প্রাণঘাতী করোনা। করোনার প্রভাবে বাংলাদেশেও বিরাজ করছে লকডাউন পরিস্থিতি। হাট-বাজার, দোকান, যানবাহন সহ প্রায় সব কিছুই বন্ধ। লোকজনও রয়েছে ঘরবন্দী। আতংকে অনেকেই ঘর থেকে বের হওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হতে চায়না। যার বড় প্রভাব পড়েছে এখন সবজির বাজারে। ভয়ানক এই প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের দাপটে এখন উত্তরাঞ্চলের সবজি বাজারগুলোতে ধস নেমে এসেছে। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার খ্যাত বগুড়ার সবচাইতে বড় সবজি বাজার হলো মহাস্থান হাট। এই হাট থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি ট্রাক যোগে সবজি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গেলেও বর্তমানে আগের তুলনায় সবজির আমদানি ও বিক্রি আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। সরেজমিনে হাটে অল্প পরিমাণ যে সবিজ ছিল তারও কোনো ক্রেতা ছিল না। সবজী খ্যাত মহাস্থান হাটের পাশাপাশি জেলার আরো দুটো সবজী সাজাহানপুরের নয়মাইল হাট, শেরপুরের ফুলবাড়ী বাজার। এসব হাট থেকেও প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫/২০ ট্রাক সবজী রাজধানী দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহানগরের যেতো। অথচ গত ৫দিনে সবজির অভাবে এসব হাট থেকে কোনো ট্রাক লোড হয়নি বলে আড়ৎদার ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। এদিকে সবজি বিক্রি না হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকরা। কৃষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার প্রভাবে সবজির বাজারে ধস নেমেছে। এই বাজারে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসতো সবজি ক্রয় করতে। কিন্তু বর্তমানে করোনা আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা বাজারে আসছে না। তাই ক্রেতা সংকটে সবজির দামে ধস নেমেছে। সরেজমিনে মহাস্থান হাটে গিয়ে দেখা যায়, মাঝারি সাইজের মিষ্টি কুমড়া বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস ৭ টাকা, আর মণ ২৮০ টাকা। এছাড়াও প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা, মুলার মণ কিছুটা বেড়ে হয়েছে ১৭০ টাকা। সেই সঙ্গে কাঁচামরিচ ও করলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১০ টাকা, শসা ৫ টাকা, টমেটো ৫-৬ টাকা, ফুলকপি ৫ টাকা, বাঁধাকপি ৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পটলের দাম বেড়ে হয়েছে ১১শ টাকা মণ। অর্থাৎ প্রতি কেজি সাড়ে ২৭ টাকা। এছাড়াও পেঁয়াজ ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি, বাঁধাকপি ৩/৪ টাকা পিছ, গাজর ৮ টাকা কেজি, সজনে ডাটা ১০০ টাকা কেজি, ঢেঁড়স ৩০ টাকা কেজি, লাল শাক ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বগুড়ার শিবগঞ্জের মুলা চাষি খয়বব আলী বলেন, ৩ বিঘা জমিতে মূলা চাষ করেছি। এখন বিক্রির জন্য মহাস্থান হাটে ভ্যানে করে নিয়ে এসেছি। বিক্রি করতে পারিনি। বিকেলে বিক্রি না হলে ফেরত নিয়ে যাব মহাস্থান হাটে চন্ডিহারা গ্রামের সবজি চাষি মোসলেম উদ্দিন জানালেন, তিনি বেগুন পাইকারি বিক্রি করতে এসেছেন বাজারে। কিন্তু বেগুনের দাম করছে না কেউ। মাঝে মাঝে দু-একজন ব্যবসায়ী আসলেও একেবারে কম দাম বলেও আবার চলে যাচ্ছে। বেগুন প্রতি মণ ২০০ থেকে ২২০ টাকা করে দাম হাঁকা হচ্ছে। এতে করে পরিবহন খরচও উঠবে না তার। কিন্তু তারপরও ক্রেতা নেই বলে তিনি জানান। মোকামতলা এলাকার কৃষক মোজাফফর হোসেন বলেন, শসা জমিতে বেশি দিন রেখে নষ্ট হবার উপক্রম হতে চলে বলেই বাধ্য হয়ে হাটে নিয়ে এসেছি। কিন্তু পাইকার কম থাকায় মাত্র ৫ টাকা কেজি বিক্রি করেছি। এর আগে কখনও এত কম দামে শসা বিক্রি করিনি। বেগুন, মূলা, শসার পাশাপাশি টমেটোর বাজারেও ধস নেমেছে। টমেটো চাষি মোজাম্মেল হক জানান, কাল থেকে বাজারে আর টমেটো আনবো না। টমেটো পচে জমিতে পড়লে সার হবে। তাও জমির উপকার হবে। কিন্তু কষ্ট করে বাজারে নিয়ে এসে লোকসান গুনতে হচ্ছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, দুইজন লোক দিয়ে প্রায় পাঁচ মণ টমেটো তুলতে হয়। তাদের মজুরি দিতে হয় ৮০০ টাকা। তারপরে এখন গাড়ি পাওয়া যায়না। সে কারণে ভ্যানে করে পাঁচ মণ টমেটো মহাস্থান নিতে ৫০০ টাকা লাগবে। প্রতি কেজি টমেটো পাঁচ টাকা দরে বিক্রি করলে পাঁচ মণ টমেটোর দাম আসে ১ হাজার টাকা। এখানেই লস ৩’শ টাকা। এছাড়া একজন মানুষের খাওয়া-দাওয়াসহ আরও ১০০ টাকা ধরলে সবমিলিয়ে লোকসান হবে ৪’শ টাকা। আর টমেটো ক্ষেত থেকে না তুললে এক টাকাও লোকসান হবে না। একইভাবে ৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে জেলার আরেক পাইকারী বাজার নয়মাইল হাটের চিত্রও প্রায় একই রকম। সেখানেও সাংসারিক প্রয়োজনে সবজী নিয়ে এ হাটে কৃষকরা আসলেও পাইকার না থাকায় পানির দামে বিক্রি করতে দেখা গেছে। এদিকে কৃষক-দিনমজুরের বেতন পারিশ্রমিক দিয়ে সবজী ফসল ফলিয়ে কৃষকদের লোকসানের পাল্লাই বেশী হচ্ছে কৃষকরা অভিযোগ করছে। এ ব্যাপারে উপজেলার মহাস্থান হাটের ইজারাদার আলহাজ্ব আজমল হোসেন জানান, স্বাভাবিক সময়ে কাঁচা বাজারকে ঘিরে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলার দুই থেকে তিন হাজার পাইকার এ হাটে আসতো। কিন্তু সপ্তাহ খানেক ধরে করোনাভাইরাসের জন্য পাইকাররা আসতে না পারায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে পাইকারি বাজারে সবজির দাম একে বারে কম হলেও শহরের খুচরা বাজারগুলোতে ৫-৬ গুণ বেশি দামে সবজি বিক্রি হচ্ছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে আমদানি কমের অজুহাতে তারা বেশি দামে সবজি বিক্রি করছেন। তবে দেশে যদি লকডাউন পরিস্থিতি আরো বেশীদিন থাকে তাহলে সবজির বাজারের পরিস্থিতি করুনসহ কৃষক ও ব্যবসায়ীরদের লোকসান পুষিয়ে উঠা সম্ভব নয় বলে দাবী করেন।