সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার নারীরা কুমড়ো বড়ি বানানো নিয়ে ব্যস্ত জীবন পার করছেন। মাসকলাইয়ের ডাল আর চাল কুমড়ার মিশ্রণ রোদে শুকিয়ে তৈরি হয় কুমড়ো বড়ি। এই বড়ি দিয়ে কৈ, শিং বা শোল মাছের ঝোল বেশ জনপ্রিয়। কুমড়ো বড়ি তৈরির উপযুক্ত সময় শীতকাল। তাইতো সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে নারীরা ব্যস্ত কুমড়ো বড়ি বানানো নিয়ে। নিজের বাড়ির চাহিদা মিটিয়ে এই কুমড়ো বড়ি রপ্তানি হচ্ছে সারাদেশের জেলা উপজেলার হাট-বাজারে।
শাহজাদপুর উপজেলার গাঁড়াদহ ইউনিয়নের তালগাছী গ্রামের জাহানারা খাতুন বলেন, এলাকার শত শত নারী কুমড়ো বড়ি তৈরির কাজে এখন ব্যস্ত। শীতের আসার সাথে সাথে কুমড়ো বড়ি তৈরির ব্যস্ততা বেড়ে যায়।
আরেক ব্যবসায়ী মনোয়ারা বলেন, আশ্বিন মাস থেকে ফাল্গুন এই ছয়মাস কুমড়ো বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা বাজারে বিক্রি করা হয়। শীতের চাহিদা থাকায় গ্রামগঞ্জের নারীরা বাড়তি আয়ের জন্য কুমড়ো বড়ি তৈরি করেছে।
উপজেলার গাঁড়াদহ ইউনিয়নের তালগাছি গ্রামের মুনজুরুল বলেন, এক কেজি কুমড়ো বড়ি তৈরি করতে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ টাকার মতো খরচ হয়। আমরা সেই কুমড়ো বড়ি পাইকারিওয়ালার কাছে বিক্রি করি ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। আর বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়।
উপজেলার কুমড়ো বড়ির ব্যবসায়ী নির্মল সরকার বলেন, এখানকার কুমড়ো বড়ি সুস্বাদু হওয়ায় এই অঞ্চলের কুমড়ো বড়ি এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জেলা উপজেলায় পাঠানো হয়। বিশেষ করে ঢাকা, পাবনা ও রাজশাহীতে এর চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
আরেক ব্যবসায়ী মো. মোস্তফা হোসেন বলেন, এখানকার কুমড়ো বড়ি সারা বছরই তৈরি হয়। তবে শীতকালে কদর বেশি। কারণ, শীতের সময় রান্না করে খেতে বেশি মজা। বিশেষ করে দেশি মাছের সাথে। কুমড়ো বড়ি বানানো থেকে শুরু করে সব কাজই বাড়ির মেয়ে বা নারীরা করে থাকেন।
জাহানারা খাতুন বলেন, কুমড়ো বড়ি বানাতে আগে অনেক কষ্ট হতো মাসকলাই পানিতে ভিজিয়ে রেখে চাল কুমড়ো দিয়ে পাটায় পিষে সেটা মিশ্রণ করে রোদে শুকিয়ে তৈরি হত কুমড়ো বড়ি।
তিনি আরও বলেন, এখন আর আগের মতো কষ্ট হয় না মাসকলাই মেশিনের নিয়ে মাড়াই করে চাল কুমড়ো মিশ্রণ করে রোদে শুকিয়ে তৈরি হয় কুমড়ো বড়ি।
কুমড়ো বড়ি তৈরির প্রধান উপকরণ মাসকলাইয়ের ডাল, চাল কুমড়া আর সামান্য মসলা। স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি মাসকলাই ১০০ থেকে ১২০ টাকা আর চাল কুমড়া ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ৫ কেজি চাল কুমড়ার সাথে দুই কেজি মাসকলাইয়ের মিশ্রণে কুমড়ো বড়ি ভালো হয়। প্রথমে মাসকলাই রোদে শুকিয়ে যাঁতায় ভেঙে পরিষ্কার করে পানিতে ভিজিয়ে রেখে খোসা ছাড়িয়ে নেয়া হয়। প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা মাসকলাই পানিতে ভেজাতে হয়। তারপর মেশিনে বা পাটায় পিষে কুমড়ো বড়ির মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এরপর দুইটির মিশ্রণে কুমড়ো বড়ির উপকরণ তৈরি হয়। রৌদ্রোজ্জ্বল ফাঁকা স্থান, বাড়ির আঙ্গিনা, ছাদ বা খোলা জায়গায় ভোর থেকে বড়ি তৈরি করা শুরু হয়। পাতলা কাপড় বা টিনের উপর সারি সারি বড়ি রোদে রাখা হয় শুকানোর জন্য। কুমড়ো বড়ি বানানোর পর ২ থেকে ৩ দিন টানা রোদে শুকাতে হয়। সূর্যের আলো কম হলে ৩ থেকে ৪ দিন পর্যন্ত সময় লাগে।
জাহানারা খাতুন জানান, আমি ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে এই কুমড়ো বড়ি তৈরি করি। আমার বাড়ির চাহিদা মিটিয়ে জেলা উপজেলাসহ সারা বাংলাদেশে রপ্তানি করি। কুমড়ো বড়ি বিক্রি করে আমার সংসার চালিয়ে যে টাকা আয় হতো সেই টাকা দিয়ে আমি তিন ছেলে মেয়েকে সুশিক্ষকায় শিক্ষিত করেছি। আমি কুমড়ো বড়ি বিক্রি করে উপজেলার তালগাছীর বুকে ৯ শতাংশ জায়গা কিনে বাড়ি করে আল্লাহর কৃপায় স্বামী ছেলেমেয়েকে নিয়ে এখন পরিপূর্ণ সুখী।
স্থানীয়রা জানান, জাহানারা খাতুন একদম গরিব ছিলেন। তিনি হঠাৎ করে এই কুমড়ো বড়ি তৈরি করার কাজ শুরু করল। সেখান থেকেই তার ভাগ্য খুলে যায়। তিনি দীর্ঘ ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে কুমড়ো বড়ি তৈরি করে জেলা-উপজেলায় রপ্তানি করেন এবং তালগাছীর বুকে ৯ শতাংশ জায়গা কিনে বাড়ি করে ছেলেমেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে এখন জাহানারা খাতুন পরিপূর্ণ সুখী। জাহানারা খাতুন এর পরিবর্তন দেখে এলাকার নারীরা এই কুমড়ো বড়ির প্রতি অগ্রসর হয়েছে।