তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি
চলনবিলের হাট-বাজারে সন্ধ্যা হলেই পিঠা বিক্রি করেন মৌসুমী ভ্রাম্যমাণ পিঠা বিক্রেতারা। চলনবিলাঞ্চলে পৌষ সংক্রান্তি অর্থাৎ পুসরা আয়োজনে গোবর দিয়ে প্রলেপ দেয়া হয় হিন্দু বাড়িগুলোতে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় বাড়ির চারিদিকে। সেসময় বাড়ির উঠান, ঘর দরজা ঝকঝক তকতক করে। এক কোণে তুলসী মন্দিরের সামনে চালের গুঁড়োর বাহারি নকশা। বাড়ির ঘর-দরজা, আসবাবপত্রে শোলার তৈরী ফুল ঝুলানো হয়। পৌষ সংক্রান্তি তথা পুসরা উপলক্ষ্যে হিন্দু বাড়িগুলোতে গিয়ে দেখা যায় বাড়ির কোনে ধুয়ে মুছে সিঁদুর মাখিয়ে রাখা ঢেঁকি। বাড়ির রান্নাঘরগুলোতে গেলে আরো দেখা যায়, সামনে থরে থরে সাজানো নানা রকম পুলিপিঠে, পাটিসাপটা, আস্কে পিঠে, গোকুল পিঠে, ভাজা পিঠে, চন্দ্রপুলি, ক্ষীরপুলি, দুধপুলি, চন্দ্রকান্তা, মুগসামলি, গোকুল পিঠে, সরুচুকলি, ভাজাপিঠে, ভাপাপিঠে, রসপিঠে, আরও কত কী। মাসকালাই ডালের রসবড়ার স্বাদই আলাদা। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান উঠলেই প্রস্তুতি শুরু হত শীতকালীন পিঠাপুলি পায়েসের আয়োজন। নতুন কি পুরাতন আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে নিয়ে আসার রেওয়াজ ছিল। ঢেঁকিতে নতুন চাল গুঁড়ো করা শুরু হল মানেই মকর পর্ব এসে গেল। একসময় চলনবিলাঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে তিনদিন ধরে উৎসব হতো। গরুকে ভোরে স্নান করানো, তার শিংয়ে তেল মাখানো পিঠার প্রলেপ দেয়া, আমন ধানের স্তুপাকার করে রাখা খড় (নাড়া) পোড়ানো, উৎসব মানে আতপ চাল, দুধ, গুড় দিয়ে নানা রকম পিঠেপুলি তৈরি করে পাড়া-প্রতিবেশিদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া আর এ সবই ছিল পৌষ পার্বণের একেকটা অংশ। পাড়ার বৌ ঝিয়েরা জানান, উৎসবের প্রথম দিনেই মাটির সরা পোড়াতে হয়। আর পৌষপার্বণের প্রধান কিন্তু সরা পিঠে। এছাড়াও তৈরী করা হয় হরেক রকম পিঠাপুলি। একসময় প্রথম দিন সরার ভিতরে ধানের তুষ রেখে পাটকাঠি (শোলা) আগুনে কিছুক্ষণ পুড়িয়ে সরাকে (পিঠা ভাজার কড়াই) তৈরি করে নিতে হয়। নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় সরা পিঠে। প্রথমটি দেওয়া হয় গরুকে, তারপরে ঘরে। পুসরাতে অনেক সময় ধুতি পরে বা ধোয়া পোষাক পরিচ্ছদ পরে পাথরের বাটি হাতে নিতো যারা আল্পনা দিতো তারা। সেই বাটিতে থাকত আতপ চালের গুঁড়ার তরল। সেই তরলে সাদা কাপড় ভিজিয়ে গাছে, তুলসি তলায়, উঠোনে, ঘরের দেওয়ালে ছোপ ছোপ করে দাগিয়ে দিতো বাড়ির যারা আল্পনা আঁকাতে পটু। পৌষপার্বনে আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করার রেওয়াজও ছিল। প্রতিবেশীদেরও ডাকা হতো। নয়তো তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হতো থালা বোঝাই পিঠেপুলি।