প্রভাষক শাহ রফিকুল ইসলাম, গাইবান্ধা প্রতিনিধি
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে সাঁওতাল হত্যা মামলার আসামীদের গ্রেপ্তার ও বাপ-দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি ফেরতের দাবীতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গত রোববার ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের থানা মোড়ে সকাল ১১টা থেকে প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি পুনরুদ্ধার সংগ্রাম কমিটি, আদিবাসী বাঙালি সংহতি পরিষদ, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়ন, এএলআরডি ও জন উদ্যোগের যৌথ আয়োজনে এ কর্মসূচি পালিত হয়। সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি পুনরুদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ডা. ফিলিমন বাস্কের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন চলাকালে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি কমরেড তাজুল ইসলাম, সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি পুনরুদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাফুরুল ইসলাম, অত্র কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক স্বপন শেখ, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক সুফল হেমব্রম, কোষাধ্যক্ষ গনেশ মুরমু, সাঁওতাল হত্যা মামলার বাদী থমাস হেমব্রম ও যুব ইউনিয়ন উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান প্রমুখ। কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে মোবাইল ফোনে বক্তব্য রাখেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবিন্দ্রনাথ সরেণ, সিপিবি প্রেসিডিয়াম সদস্য কেন্দ্রীয় কমিটি ও গাইবান্ধা জেলা কমিটির সভাপতি মিহির ঘোষ। এর আগে মাদারপুর জয়পুরপাড়া থেকে ব্যানার, ফেস্টুন ও লাল পতাকা হাতে সহস্রাধিক নারী-পুরুষ প্রায় ১০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে গোবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর আঞ্চলিক সড়ক, উপজেলা চত্বর ও ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক প্রদক্ষিণ শেষে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন। সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ করে বলেন, ঘটনার প্রায় চার বছর হলেও তাদের বাপ-দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নাই সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে। চূড়ান্ত অভিযোগ পত্রে ঘটনার সাথে সরাসরি যুক্ত এজাহারভুক্ত আসামী গোবিন্দগঞ্জ আসনের সাবেক সাংসদ অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ ও প্রকাশ্যে সাঁওতালদের বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগকারী অতি উৎসাহী পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ আসামীদের নাম বাদ দেয়ায় তারা বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা বলেন, সারা পৃথিবীর গণমাধ্যমে প্রকাশিত আগুন লাগানোর ফুটেজ, ছবি প্রকাশ পেলেও এখন পর্যন্ত কোন সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। এর মাধ্যমে সাঁওতালদের সাথে পরিহাস করা হয়েছে। বর্তমানে সিআইডি’র কাছে মামলাটি তদন্তাধীন আছে। সিআইডি’র কাছে মামলাটি সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে চার্জ প্রদানের দাবী করেন। বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বক্তরা আরো বলেন, করোনাকালীন সময়ে সাঁওতালদের জীবন জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। সাঁওতালরা অর্ধাহারে অনাহারে দিনযাপন করছে। কিন্তু প্রশাসন থেকে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। এসময় সভাপতির বক্তব্যে ফিলিমন বাসকে বলেন, এই বিচারহীনতা প্রমাণ করে জাতিগত সংখ্যালঘু সাঁওতালদের কত অবহেলার চোখে দেখা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে সাঁওতাল-বাঙালিরা মিলে এদেশ স্বাাধীন করেছে। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর তারা নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। সেই ভূমি উদ্ধার করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ। এখন তাদের সেই হত্যাকান্ডের ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ কোন বাংলাদেশে তারা বসবাস করছে। তিনি প্রশ্ন করেন এজন্যই কি মুক্তিযুদ্ধে তারা অংশ নিয়েছিলেন ?
অন্যান্য বক্তারা বলেন, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে দিনে-দুপুরে তিনটি মানুষকে গুলি করে হত্যা, বসতবাড়ীতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটলেও দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও আসামীদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। এই যদি হয় স্বাধীন দেশ তাহলে এমন দেশ আমরা চাইনা। সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সাঁওতাল হত্যা মামলার আসামীদের গ্রেপ্তারসহ বাপ-দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি ফেরতের দাবী জানান। অনতিবিলম্বে আসামীদের গ্রেপ্তার করা না হলে বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দেন তারা। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে আখ কাটতে যান। এসময় বাপ-দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি দাবী করে আখ কাটতে বাঁধা দেন সাঁওতালরা। এতে চিনিকল শ্রমিক, পুলিশ ও সাঁওতালদের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিন সাঁওতাল। আহত হন উভয়পক্ষের ৩০ জন। এরপর সাঁওতালদের উচ্ছেদের নামে বসতবাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে পুলিশ। লুটপাট করা হয় সাঁওতালদের গরু, ছাগলসহ ঘরের আসবাবপত্র। সবকিছু হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন সাঁওতালরা। ঘটনার প্রায় ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও গ্রেপ্তার করা হয়নি ঘটনার সাথে জড়িতদের। সেই থেকেই হত্যার বিচার ও বাপ-দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি ফেরতের দাবী করে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন সাঁওতালরা।