মাহমুদুল হাসান, চৌহালী (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি : ১৯৭১ সালে আমি এস.এস.সি পরীক্ষার্থী। আমি শুনতে পেলাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ও মূল সূত্র ৭ মার্চের এ বক্তৃতা। বঙ্গবন্ধুর এ বক্তৃতা শুনে শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ সকলের গায়ের লোম খাড়া হয়ে যেত। বঙ্গবন্ধুর স্বকণ্ঠে উচ্চারিত বক্তৃতা দেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে শুধু ঐক্যবদ্ধই করেনি, তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল। কারণ এ ভাষণই ছিল মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভাষণ। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই আহ্বানে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আমরা ১৮ জন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য ভারতে যাওয়ার প্রস্তুত গ্রহণ করি ও দিন তারিখ ধার্য করে ২৯ শে জুলাই আমরা নৌকাযোগে নাগরপুরের শাহজানি হাটে যাই। সেখান থেকে একটি নৌকা করে মানিকারচর ভারতে যাই, সেখান থেকে বাস যোগে ফুলবাড়িয়া ফেরি ঘাটে পৌঁছাই। ফেরি পার হয়ে ধুপরি পৌঁছাই, সেখান থেকে হেঁটে আমরা ধুপরি রেল ষ্টেশনে যাই এবং ট্রেনে কালিগঞ্জে আসি। পরে বাস যোগে বালুঘাট (পশ্চিম দিনাজপুর) যাই, সেখান থেকে টমটম গাড়িতে ইয়োস ক্যাম্প কুড়িমাইল যাই। ক্যাম্পে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা আমাদের মেডিকেল করে ভর্তি করেন। পরেরদিন সকাল থেকে শুরু হয়ে প্রশিক্ষণের পিটি প্যারেট চলে ৭ দিন। উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য শিলিগুড়ি পানি গাটা ক্যাম্পে পাঠান, ৭ দিনের প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা ক্যাম্পে ভর্তি করা হয়। এরপর ২১ দিনের উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে তরঙ্গপুর সীমান্তে অপারেশন যুদ্ধ ক্যাম্পে পাঠান। আমরা সবাই প্রস্তুত যুদ্ধের সামগ্রী নিয়ে, পরে ক্যাম্প ইনচার্জ মহিউদ্দিন সবাইকে ডেকে সকল সরঞ্জাম বুঝিয়ে দেন। হিলি সীমান্তে যেতে গাড়িতে উঠে বসলাম এবং যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছালাম। আমাদের কোম্পানি কমান্ডার ২ প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ার ও গোলাবারুদসহ বাঙ্কারে প্রবেশের কমান্ড করল। আর বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্ত এলাকায় অপারেশন ক্যাম্পে রাখা হয়। আমরা পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করি, ৭ দিন যুদ্ধের পর জানতে পারি আমাদের ১০ জন সহযোদ্ধা নিহত, সেখানে পাক বাহিনীর কতজন মারা গেছে জানা সম্ভব হয়নি। সেই যুদ্ধ পরিবেশন করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। পরে আমরা চলে আসি তরঙ্গপুর অপারেশন ক্যাম্পে, ৭ দিন বিশ্রামের পর ক্যাম্প ইনচার্জ মহিউদ্দিন ১৭ সেপ্টেম্বর হাতিয়ার গোলা বারুদ দিয়ে বাংলাদেশে পাঠান। নিজ নিজ বরাদ্দের সরঞ্জাম গোলা বারুদ হাতিয়ার নিয়ে তরঙ্গপুর থেকে কালিগঞ্জ ট্রেনে ধুপরি ষ্টেশনে আসি, পরে ফেরি পার হয়ে ফুলবাড়িয়া বাসযোগে মানিকারচর আসি, সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করে চলে আসি নির্ধারিত নিরাপদ স্থানে। সন্ধ্যার পরে আবার নৌকা ছেড়ে দিয়ে রাত্রি ৩টার দিকে সোনাতনী ঘাটে নেমে হেঁটে চলে আসি বেনোটিয়া গ্রামে বুধু ডাক্তারের বাড়িতে। পরে নদী পার হয়ে নিজ গ্রামে আসি। আমাকে দেখে বাবা, মা, দাদা-দাদি সবাই আনন্দে আত্মহারা। ১/২দিন পরে খোঁজ-খবর নিয়ে সন্ধ্যায় নদী পার হয়ে বেনোটিয়া বুধু ডাঃ এর বাড়িতে যাই এবং ৮ জন চলে আসি দত্তকান্দি গ্রামে। ১৬ জন চলে যায় ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে নিরাপদ স্থানে। আমরা হাজ্বী জিলেন সরকারের বাড়ি থেকে বাইশা রাজাকারদের সন্ধান নেই এবং গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজাকার অপারেশন করি বাউশা গ্রামে, কিন্তু ওরা সংবাদ পেয়ে অনত্র সরে যায়। পরে আমরা দত্তকান্দি সরকারি প্রাইমারিতে ক্যাম্প করি এবং সন্ধান নিতে থাকি। দৌলতপুর থানা চরকাটারি গ্রামে রশিদ ডাক্তারের বাড়ি ৭ জন মুক্তিযোদ্ধার ক্যাম্প কমান্ডার আব্দুল কাদের এর সাথে যোগাযোগ করে একত্রিত হই। আমরা সংবাদ পেলাম সিরাজগঞ্জ থেকে নদী পথে বেশ কিছু রাজাকার আলবদর আসছে। তাদের পিছনে সুম্ভদিয়া ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধা আছে জেনে আমরা নদীর পারে যেতেই রাজাকাররা আত্মসমর্পণ এর উদ্দেশ্যে সাদা পতাকা উড়িয়েছিল। তারা হাতিয়ার নীচে রেখে হাত উপরে দিলে, তখন আমরা হাতিয়ার নিয়ে নেই এবং তাদের আত্মসমর্পণ করাই। সুম্ভদিয়া, চরকাটারি ও দত্তকান্দি ক্যাম্পে ৭টি করে ২১টি হাতিয়ার দেয়া হয়। সর্বমোট ২১ জন রাজাকারের নিকট থেকে ২১টি ৩০৩ রাইফেল পাওয়া যায়। আমরা চরকাটারি হতে পাথরাইল গ্রামে হাজ্বী নিয়ামতের মাদ্রাসায় ক্যাম্প করি, সকালে একজন সেন্ট্রি জানায়, মাদ্রাসার পাশ দিয়ে ১৫/২০ জন পাক হানাদার পায়ে হেঁটে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। সংবাদ পেয়ে হাতিয়ার নিয়ে দ্রুত কমান্ডারের কমান্ডে ফায়ার করতে থাকি, তাদের পিছনে বাচামারা চলে যাই। পরে ওরা নদী পার হয়ে যায় পড়ে থাকা এক পাকহানাদার এর মৃতদেহ দেখতে পাই। পরে জানতে পারি ওরা মানিকগঞ্জ ক্যাপ্টেন হালিমের গ্রুপে আত্মসমর্পণ করে। ১৬ ডিসেম্বর এর কয়েকদিন পূর্বে এক ঝাঁক যুদ্ধ বিমান দেখা যায় আকাশে, তখন আমরা বুঝতে পারি দেশ স্বাধীন হতে আর দেরি নেই। আজ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল, দেশ স্বাধীন হয়েছে, সংবাদ পেয়ে ক্যাম্পের সামনের মাঠে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। সেখানে আনন্দ মিছিল করি আমরা। দেশ স্বাধীন হল, সারা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা দাবি জানালো এবং স্লোগান দিল, ‘শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করবো’। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধীর বিভিন্ন দেশের সাথে কুটনৈতিক যোগাযোগের কারণে পাকিস্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেয়ে দেশে আসার কিছুদিন পরে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার ঘোষণা দেন। সে ঘোষণা মতে আমরা সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসন এর নিকট অস্ত্র জমা দেই আমাদের কমান্ডের নেতৃত্বে। পরে আমরা সবাই যার যার বাড়ি চলে আসি।
——বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিকালীন সহ কমান্ডার মোঃ জসিম উদ্দিন (টু, আইসি)।