গাইবান্ধা প্রতিনিধি : দেশের গ্রামীণ জনপদে একটা সময় বাঁশঝাড় ছিল না এমনটা কখনও কল্পনাও করা যেতো না। যেখানে গ্রাম সেখানেই ছিলো বাঁশঝাড় আর বেতের চাষ। কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে বাঁশঝাড় ও বেত। দেশের কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান লোকজীবনের সঙ্গে মিশে আছে। বাঁশ, বেত এর মধ্যে অন্যতম। তবে জনজীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্প। একসময় গ্রামীণ জনপদে তৈরি হতো বাঁশ ও বেতের হাজারো পণ্য সামগ্রী। বাড়ির পাশের কাছের ঝাড় থেকে তরতাজা বাঁশ কেটে গৃহিণীরা তৈরী করতেন হরেক রকম জিনিস। অনেকে এ দিয়ে আবার জীবিকাও নির্বাহ করতেন। বর্তমানে এ শিল্পের সাথে জড়িত অনেকেই বাপ-দাদার আমলের পেশা ত্যাগ করে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। একটা সময় বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসপত্রের কদর ছিল। চেয়ার, টেবিল, বই সেলফ, মোড়া, কুলা, ঝুড়ি, ডোল, চাটাই থেকে শুরু করে এমনকি ড্রইং রুমের আসবাবপত্র তৈরিতেও বাঁশ ও বেত ব্যবহার করা হতো। এছাড়াও মাছ ধরার পলো, হাঁস-মুরগির খাঁচা, শিশুদের ঘুম পাড়ানোর দোলনা এখনো গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
একসময় গাইবান্ধার সুুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বিপুল পরিমাণে এসব বাঁশ ও বেতের সামগ্রী তৈরী হয়ে উপজেলা হাট-বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হয়ে যেতো। এখন সচরাচর গ্রামীণ উৎসব বা মেলাতেও বাঁশ ও বেতজাত শিল্পীদের তৈরি উন্নতমানের খোল, চাটাই, খালুই, ধামা, দোয়াড়, আড়ি, টোনা, আড়, হাপটা, মোড়া, বুক সেলফ চোখে পড়ে খুবই কম। প্রান্তিক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সুবিধা যেমন হাত পাখার চাহিদা কমিয়েছে তেমনি মৎস্য শিকার, চাষাবাদ, ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র সকল ক্ষেত্রেই কমেছে বাঁশ আর বেত জাতীয় হস্তশিল্পের কদর। প্রকৃতপক্ষে বাঁশ বেতের স্থান অনেকটাই প্লাস্টিক সামগ্রী দখল করে নিয়েছে। তাছাড়া এখন বাঁশ ও বেতের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এর দামও বেড়ে গেছে। ফলে বাঁশ ও বেতের সামগ্রীর ব্যয়ও বেশি হচ্ছে। সৌখিন মানুষ ঘরে বাঙালির ঐতিহ্য প্রদর্শনের জন্য বাঁশ বেতের সামগ্রী বেশি দাম দিয়ে কিনলেও মূলত ব্যবহারকারীরা বেশি দাম দিতে চান না। স্বল্প আয়ের মানুষেরা গ্রামের সমিতি ও বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও থেকে লোন নিয়ে বাঁশ ও বেতজাত দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করে বিক্রি করলেও এতে তাদের খরচ পোষায় না। এর ফলে তারা অন্য পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে বাঁশ ও বেতের সামগ্রী যারা তৈরি করছে তাদেরকে সরকার এবং বিভিন্ন এনজিওর সহায়তা করা অত্যন্ত জরুরী বলে মন্তব্য করেছেন সচেতন মহল। বাংলার ঐতিহ্য বাঁশ ও বেতের সামগ্রীকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর পেছনের মানুষগুলোকে আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে তাদের পেশাকে বাঁচাতে হবে। প্রয়োজন হলে এই শিল্পের সাথে জড়িত পরিবারগুলোর মাঝে বিনা সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় এসব সুন্দর বাঁশ ও বেতের হস্তশিল্প একদিন জনজীবন থেকে হারিয়ে যাবে।
উপজেলার মীরগঞ্জ দাস পাড়ায় বাঁশ শিল্পের সঙ্গে জড়িত গৌতম চন্দ্র দাস, গৌরাঙ্গ দাস, শ্রীমতি সুমি রানী দাস জানান, আগের মত আর চলছে না তাদের ব্যবসা। দিন দিন গ্রামে বাঁশের ঝাড়গুলো কেটে ফসলী জমি ও বসতবাড়িতে পরিণত হয়ে হাট-বাজারে বাঁশের সংকট হয়ে পড়েছে। এ থেকে হাট-বাজারে অতিরিক্ত দামে বাঁশ ক্রয় করতে হচ্ছে তাদের। বাঁশের তৈরি সামগ্রী বাজারজাত করে এখন সংসার চলা বড় কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজারে স্বল্প দামে পাওয়া প্লাস্টিক সামগ্রীর দখলে চলে গিয়েছে। তাই এখন বাঁশের তৈরি সামগ্রীর কদর নেই বললেই চলে। অনেকেই এই বাপ দাদার পেশা বাদ দিয়ে অনান্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা জাফর আহম্মেদ লস্কর বলেন, উপজেলার প্রায় ২ শতাধিক পরিবার বাঁশের তৈরি সামগ্রী বিক্রয় করে সংসার চালাচ্ছে। পর্যায়ক্রমে তাদের হস্ত ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে স্বল্প লাভে ঋণ প্রদান করা হবে।