পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি
ভোজন রসিকদের জন্য শীতকাল উত্তম সময়। শীতে খাবার খাওয়ার মজাই আলাদা। শীতকাল আসলেই বাঙ্গালী পরিবারগুলির মধ্যে পিঠা পায়েসসহ নানা ধরনের বাহারি খাবারের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। প্রতিটি পরিবারের মধ্যে চলে নানা ধরনের বাহারী খাবার তৈরীর প্রতিযোগীতা। সেই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এমনই নানা ধরনের খাবার তৈরীর প্রতিযোগিতা। এসব খাবারগুলির মধ্যে অতি সুস্বাদু খাবার হলো ডাল দিয়ে কিংবা কচু দিয়ে তৈরী বড়ি। সেই আবহমান কাল থেকেই বাঙ্গালী প্রতিটি পরিবারের শীতকাল আসলেই কনকনে ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে চলে এই বড়ি তৈরীর প্রতিযোগিতা। এক একটি পাড়াতে যদি একজন বড়ি তৈরী করতে যায় তাহলে সেই পাড়া ধরে প্রায় সকলে একসাথে বড়ি তৈরী করে থাকেন।
জানা গেছে, অতিব সুস্বাদু এই খাবার তৈরী করতে লাগে ঠিকরে কলুই ডাল, চাল কুমড়া ও কচু। ডালের বড়ি তৈরীর এইসব উপকরণ এখন অনেক দাম দিয়ে কিনতে হয়। যে কারণে ডালের বড়ি তৈরীতে অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। অথচ ১৫/২০ বছর আগে এই ডালের বড়ি তৈরীতে ছিল অনেকেরই আগ্রহ। সেই কাকডাকা ভোরে মারাত্মক শীতকে উপেক্ষা করে সকলে দলবদ্ধভাবে ডাল কুটতে যেতেন যাদের বাড়িতে ঢেঁকি আছে। আগেরদিন ডাল কুটবে বলে ঢেঁকির মালিকদের বলে আসতে হতো। ডাল কুটে সকলে আবার একসাথে রৌদ্র উঠার আগেই একে অন্যকে সহযোগীতা করে বড়ি দিতেন ছাদে কিংবা পরিষ্কার খোলা মাঠে। আবহাওয়া যদি খারাপ থাকতো তাহলে সকলে বলত, মনে হয় কেহ বড়ি দিয়েছে সে কারণে আবহাওয়া খারাপ। এমনটাই প্রচলন ছিল এলাকায়।
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী এস এম মোস্তাফিজুর রহমান পারভেজ জানান, ভোজন রসিকদের একটি অন্যতম খাবার মেন্যুর মধ্যে ডালের বড়ি অন্যতম। যে কোন তরকারিতে এই বড়ি দিলে তার স্বাদ পাল্টে যায়।
ভিলেজ পাইকগাছার রহিমা বেগম জানান, শীতকালে তৈরী হয় ডালের বড়ি। এখন থেকে ১৯/২০ বছর আগে আমরা গ্রামের সকলে দল বেঁধে যেতাম ঢেঁকিতে ডাল কুটতে। এখন আর ঢেঁকি পাওয়া যায় না অনেক গ্রামে। তিনি জানান, পাড়ার যে কেউ একজন ডাল পানিতে ভিজাতে দিলে তার সাথে আরো অনেকেই ডাল পানিতে ভিজাতে দিতো। ৭/৮ জন একসাথে অনেক রাতে যাদের বাড়িতে ঢেঁকি রয়েছে তাদের বাড়িতে যেতাম ডাল কুটতে।
লস্করের অঞ্জু রাণী মন্ডল জানান, আগে বড়ির ডাল যাতায় ভেঙ্গে খোসা ছাড়িয়ে তারপর জলে ভিজিয়ে রাখা হতো। খোসা থাকলে কালো দেখা যায় সে কারণে খোসা ছাড়ানো হয়। এরপর রাতে পাড়ার আরো অনেক মহিলারা একসাথে ঢেঁকিতে ডাল কুটতে যেতাম। কিন্তু এখন আর ঢেঁকি না থাকার কারণে ডাল ভাঙ্গতে হয় মেশিনে।
পৌরসদরের তাসলিমা জানান, ছোট বেলায় দেখেছি ঢেঁকিতে ডাল কুটতে। কিন্তু এখন আর ঢেঁকিতে ডাল কুটা হয় না। এখন মেশিনে ডাল মাড়াই করে আনতে হয়। প্রতি কেজি ডাল কুটতে নেয় ১৫/১৬ টাকা।
গদাইপুরের শিউলি বেগম জানান, খোসা ছাড়ানো ডালের দাম কেজি প্রতি ১৪০/১৫০ টাকা। এক কেজি ডালে দুই কেজি চাল কুমড়ো লাগে। প্রতি কেজি কুমড়োর মূল্য ১৫ থেকে ২০ টাকা। এছাড়া কচু দিয়েও বড়ি তৈরী করা হয়ে থাকে।
পৌরসদরের আসিয়া বেগম জানান, মেশিনে ডাল কুটে এনে তাতে পরিমাণমত চাল কুমড়া মিশিয়ে হাত দিয়ে চটকিয়ে ছোট ছোট করে পরিষ্কার কাপড়ের উপর বড়ি দিতে হয়। ২/৩ দিনের রৌদ্রে বড়ি শুকিয়ে যায়। এরপর এটি সুস্বাদু খাবারে পরিণত হয়।
সেবিকা (নার্স) সাথী মন্ডল জানান, সকলে সুন্দরভাবে এই বড়ি দিতে পারেন না। এটি একটি আর্ট। উপজেলার সর্বত্র এখন চলছে বড়ি তৈরীর কাজ। যা সারা বছর ধরে খাওয়া চলবে। এখন ডালের বড়ি বাণিজ্যিকভাবেও তৈরী হচ্ছে। দোকানেও কিনতে পাওয়া যায়।