আবুল কালাম আজাদ: পৃথিবীর মানচিত্রে ভারতীয় উপমহাদেশটা নতুন আঙ্গিকে রঙ্গিন হলো ১৯৪৭ সালের আগস্টে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নাম নিয়ে দু’টি রাস্ট্র পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নিল। ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান আবার দু’টি অংশে বিভক্ত। পূর্ব বাংলা (পরবর্তীতে নামান্তরিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান) এবং পশ্চিম পাকিস্তান। মাঝখানে বিরাট ভারত রাজ্য। প্রায় দুি হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ব্যবধানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। তবে পাকিস্তানের দুটি অঞ্চলের মধ্যে ভাষাগত, সাংস্কৃতিক, আচার-ব্যবহার কিংবা ভৌগোলিক দিক দিয়ে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন দিক দিয়ে বিস্তর মৌলিক ফারাক থাকার পরেও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হিসেবে একমাত্র ধর্মের ভিত্তিতেই পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হলো।
মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারি দল মুসলিম লীগের সম্মেলনে শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা অর্থাৎ বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি স্বতন্ত্র রাস্ট্র এবং পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা অর্থাৎ পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান নিয়ে আরেকটি রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। কিন্তু ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত আইন সভার সদস্যদের সম্মেলনে মিঃ জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান “টাইপের ভুল বললেন। এবং স্টেটস (States) এর স্থলে স্টেট (State) করেন অর্থাৎ States এর ‘s’ বাদ দিয়ে একটি মাত্র রাস্ট্র (state) পাকিস্তান করলে ১৯৪০ সালের পূর্বাঞ্চলে স্বাধীন রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শেরে বাংলার প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।
নতুন সৃষ্ট পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জীবনে প্রথমবারের মত পূর্ব বঙ্গে আসেন ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে। পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল, গণপরিষদের সভাপতি এবং মুসলিম লীগেরও সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বঙ্গ সফরে এসে ঢাকা ও চট্টগ্রামে জনসভায় বক্তৃতা করেন। মার্চ মাসের ২১ তারিখে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত প্রথম সভায় তিনি দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘পাকিস্তানের রাস্ট্র ভাষা উর্দু-৷ অন্যকোন ভাষা নয়।’
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘আমি খুব স্পষ্ট করেই বলছি, পাকিস্তানের রাস্ট্র ভাষা হবে উর্দু এবং অন্যকোন ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তা’হলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।’
পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র সাত-সাড়ে সাত মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সেদিন তার অজান্তে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলকে পৃথকীকরণের করাতটা চালিয়ে ফেলেন। বলা যেতে পারে নিজ অহংময়তার বশবর্তী হয়েই বিচক্ষণ বুদ্ধিদীপ্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এমন অদূরদর্শী কাজটা করে ফেলেছিলেন। অবশ্য ইনসান হিসেবে অহংময়তার অদৃশ্য সাগরে ডুবে যাওয়া মোটেই অসম্ভব নয়। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা বোধ করি অতিরঞ্জন করা হবে না যে, পূর্ব বাংলার মুসলমানরা তাকে জিন্নাহ সাহেব, কায়েদ ই আজম, জাতির পিতা, মুসলিম লীগের সভাপতি বলতে পাগল ছিল। মিঃ জিন্নাহ তার প্রতি ভক্তিতে গদগদ পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরকে দূর্বল ভেবে মোক্ষম অস্ত্রটা ব্যবহার করতে সাহসী হয়ে ঘোষণা করলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাস্ট্র ভাষা। তার প্রতি বাংলার মুসলমানদের শ্রদ্ধাবোধ থেকেই তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, তার ঘোষণাকে বাংলার মানুষেরা অবশ্যই সম্মানিত করবে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তার অনুরূপ ঘোষণার বিরোধিতা করে ছাত্ররা সাথে সাথে ‘নো’ ‘নো’ ধ্বনিতে হল প্রকম্পিত করলে জিন্নাহ সাহেব কিছুক্ষণের জন্য বক্তৃতা প্রদান বন্ধ রাখেন এবং বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে দ্রুতই অনুষ্ঠানস্থল হতে বেরিয়ে পড়েন। ঐদিন বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি দল তার সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাস্ট্র ভাষা করার দাবি করেন। কিন্তু জিন্নাহ তার সিদ্ধান্তে অনড় অবস্থায় থাকলে তার সাথে ছাত্রদের তীব্র বিতর্ক হয়ে ঝগড়াঝাটির পর্যায়ে পৌঁছে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পরে তার উত্তরসূরীরাও তার রেখে যাওয়া পথে হাটতে থাকেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নতুন রাস্ট্রের মুদ্রা, মানি অর্ডার ফরম, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড, ডাকটিকেট সবগুলোতে কেবল উর্দু ও ইংরেজি ব্যবহৃত হতে থাকে।পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত অবাঙালি কর্মকর্তারা বাঙালি কর্মকর্তাদের সাথে বিরূপ আচরণ করতে থাকে। ঠিক একই অবস্থার শিকার হলেন পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তারাও। পাকিস্তানের নৌবাহিনী, সেনাবাহিনীসহ সরকারি চাকরিতে অবাঙালিদের প্রাধান্য ছিল আকাশচুম্বী। নৌবাহিনী, সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তির সব পরীক্ষা উর্দু আর ইংরেজিতে অনুষ্ঠিত হতে লাগলো। পূর্ব বাংলার মানুষদেরকে সুবিধা বঞ্চিত রাখতে এ অপতৎপরতা সরকারের প্রতিটা সেক্টরেই বিদ্যমান হয়ে পড়ে। ‘উপযুক্ত প্রার্থী নেই ‘ বলে অজুহাত দেখিয়ে অধিকাংশ হারে বাঙালিদেরকে বিভিন্ন চাকরি থেকে বাদ দেয়ার প্রবনতা পরলক্ষিত হতে থাকে। অতি সংক্ষেপে বলা যায়, রাস্ট্র ক্ষমতায় আসীন পাকিস্তানের উর্দু ভাষার শাসকরা পাকিস্তান থেকে যেন ‘বাংলা হঠাও’ ভূমিকা পালন করতে থাকে।
সৃষ্টির পর পাকিস্তানের রাস্ট্র ভাষা কী হবে তা নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের ১৪ তারিখের আগে থেকই বিতর্কের সূত্রপাত হয়। নতুন রাস্ট্র পাকিস্তানের রাস্ট্র ভাষা উর্দু হবে – মর্মে যুক্তি দিয়ে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘ আজাদ পত্রিকায় এক নিবন্ধ ছাপা হয়। নিবন্ধটিতে উল্লেখিত ভাষার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে যশোর এম এম কলেজের তদানীন্তন ছাত্রী হামিদা রহমান ‘স্বাধীনতা পত্রিকায়’ একটি চিঠি লিখলেন। “পূর্ব পাকিস্তানের রাস্ট্র ভাষা হবে বাংলা” উল্লেখ করা উক্ত চিঠিটা পাকিস্তান সৃষ্টির আগে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের জুলাইয়ের ১০ তারিখে স্বাধীনতা পত্রিকায় “পূর্ব পাকিস্তানের রাস্ট্র ভাষা” শিরোনামে প্রকাশিত হয়। — চলবে-