বিশেষ সম্পাদকীয়
ধূমপান যে বিষপান তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা জেনেশুনেই বিষ করছি পান। প্রতিবছর ধূমপান বিরোধী মিছিল, সমাবেশ করা হলেও তাতে যে সুফল আসছে সে কথা বলা যাবে না। বরং দিনদিন বাড়ছে ধূমপায়ীর সংখ্যা। এতে বাড়ছে রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। তারপরও থেমে নেই ধুমপান।
তামাকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে জনসচেতনতা বাড়াতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয়। কিন্তু সরকারিভাবে এখনো জাতীয় তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয় না। ২০১১ সালের ৯ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে তামাকবিরোধী জোট দেশব্যাপী জাতীয় তামাকমুক্ত দিবস উদযাপন করে আসছে। সারাদেশে বিগত বছরগুলোতে তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত সংগঠনগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন, কর বৃদ্ধি, ধূমপানমুক্ত স্থান বৃদ্ধি, প্যাকেটের গায়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান, তামাকজাত দ্রব্যের ওপর কর বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য দিয়ে সভা, সেমিনার, অবস্থান কর্মসূচি, র্যালিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করে আসছে।
ধূমপান ও তামাক হচ্ছে বহুবিধ ক্ষতির কারণ। ধূমপান হচ্ছে মাদক সেবনের প্রবেশ পথ। তরুণরা সিগারেটের মাধ্যমে নেশাগ্রস্ত হয়। এদের অনেকে পরে মাদকের নেশায় ধাবিত হয়। মাদকের কারণে দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। তামাক ও মাদক যেকোন মারণাস্ত্রের চাইতেও ভয়াবহ। তামাক ও মাদকের নেশা যুবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী ধূমপান ও তামাকের নেশার মাধ্যমে অর্থ ব্যয় করছে। এতে তারা অসুস্থ হচ্ছে, কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। এতে তাদের সমস্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি দেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। আমরা লক্ষ্য করছি, আইন লঙ্ঘন করে অনেক সময় সিগারেটের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এটি বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। পাশাপাশি দেশে বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী বিড়ি-সিগারেটসহ সবরকম তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের পঞ্চাশ শতাংশ স্থানে ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদান করা হচ্ছে। সতর্কবাণী প্রদান করা হলে মানুষের মধ্যে ধূমপান ও তামাকের ব্যবহার আরও কমে আসবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যারা ধূমপান শুরু করে তাদের ৪০% সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেখেই ধূমপান শুরু করে। সিগারেটসহ মৃত্যুঘাতী পণ্যের ব্যবসা যারা করে সেসব তামাক কোম্পানি এটা জানে বলেই তারা অভিনব উপায়ে আইন লঙ্ঘন করে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই ধূমপান ও তামাকের নেশা কমাতে তামাকজাত দ্রব্যের অবৈধ প্রচারণা ও অবৈধ ব্যবসা বন্ধে তামাক কোম্পানিকে শাস্তির আওতায় আনাসহ আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আসলে ধূমপান ও তামাক সেবন একটি ভয়াবহ নেশা। এ নেশা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেমন দরকার, তেমনি আইনেরও কঠোর প্রয়োগ জরুরি।
জানা যায়, তামাকের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে ৮০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এর মধ্যে শুধু বাংলাদেশেই তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বছরে ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মারা যায়। তামাক কোম্পানির কাছে এই মৃত্যুর অর্থ তাদের ভোক্তা হারানো এবং শূন্যতা পূরণে তারা টার্গেট করে শিশু-কিশোর ও তরুণদের। ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট-২০১৪ অনুযায়ী, প্রায় ৯০ শতাংশ সিগারেট ধূমপায়ী ১৮ বছর বয়সের মধ্যে প্রথমবার ধূমপান করেন। অল্প বয়সে তামাকপণ্যে আসক্ত হয়ে পড়লে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে এবং বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ফুসফুসের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। ফুসফুস ক্যান্সার, হৃদরোগ, অকাল বার্ধক্য, মানসিক অস্থিতিশীলতাসহ নানাবিধ রোগ সৃষ্টি হয় তামাকের কারণে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, যারা কিশোর বয়সে ধূমপানে আসক্ত হয়, তাদের অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা স্বাভাবিকের তুলনায় তিনগুণ, গাঁজায় আটগুণ এবং কোকেইনের ক্ষেত্রে ২২ গুণ বেশি। অর্থাৎ তামাক ও নিকোটিন কেবল একটি আসক্তিই নয়, এটি তরুণদের আরও অনেক বিধ্বংসী আসক্তির পথে পরিচালিত করে।
তামাকের কারণে মৃত্যুর যে ক্রমবর্ধমান হার, তা কমিয়ে আনতে সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ অঙ্গীকারের অংশ হিসাবেই সরকার ২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী পাস করেছে এবং ২০১৫ সালে এ আইনের বিধিমালা পাস করেছে। আগামী দিনেও তামাক নিয়ন্ত্রণে নানামুখী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন বলবৎ থাকবে বলে আমরা আশা রাখি।
মানুষের মধ্যে ধূমপান ও তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বর্তমানে তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি ও যে আশানুরূপ পদক্ষেপ আমরা লক্ষ্য করছি, তার সফলতা ধরে রাখতে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সংগঠন, গণমাধ্যমকেও ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিশেষ করে তামাকের ক্ষতিকর বিষয়টি নিয়ে জনমনে সচেতনতা গড়ে তোলা সক্ষম হলেই ধূমপান কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। পরিবার থেকে শুরু করে গ্রামে গ্রামে ধূমপানের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলের মতো কর্মসূচী দিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। তবেই ধূমপান থেকে মানুষকে বিরত রাখা সম্ভব। আসুন সবাই মিলে ধূমপানের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি। মানুষকে ধূমপানের ক্ষতিকর বিষয়ে সচেতন করতে প্রচারণা চালাই। তবেই এক্ষেত্রে সফলতা লাভের আশা করা যায়। ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, রাজনীতিকরা এ কাজে এগিয়ে আসলে সফলতা দ্রুত আসবে।