কানু সান্যাল পাবনা প্রতিনিধি :
ধর্ষণ মামলায় সহযোগিতা করতে গিয়ে পাবনা সদরের গাছপাড়া বাজারে পুলিশের সামনে আসামীপক্ষের লোকজনের হাতে আব্দুল আলীম নামের এক যুবক মারধরের ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে কেচোঁ খুঁজতে গিয়ে যেন সাপ বেড়িয়ে আসছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, হত্যা মামলার আসামী আব্দুল আলীম ধর্ষিতার কোন আত্বীয়-স্বজন কেউ নন। ওই পরিবারের সাথে বা প্রতিবেশী হিসেবে ধর্ষণ মামলায় সহযোগী বলে দাবিদার আহত আব্দুল আলীমের কোন প্রকার যোগসুত্র নেই। এমনকি কথিত ধর্ষণ মামলার স্বাক্ষী তালিকাভুক্ত কোন স্বাক্ষীও নন তিনি। তারপরও কি উদ্দেশ্যে তিনি ধর্ষণ মামলায় সহযোগিতা করতে গেলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ধর্ষণ মামলার বাদিপক্ষের লোকজন।
জানা গেছে, সদর উপজেলার মালিগাছা ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের নওশের আলী প্রামানিক মেয়ে রুমী খাতুনের সাথে একই গ্রামের পাঞ্জাব প্রামানিকের ছেলে ফিরোজের চার বছর ধরে প্রেমের সর্ম্পক। অবিবাহিত ফিরোজের পরিবার স্বামী পরিত্যাক্ত রুমী খাতুনকে মেনে না নেওয়াকে কেন্দ্র করেই যত সব কান্ড। প্রায় তিন বছর পূর্বে আগের স্বামীর কাছ থেকে তালাকপ্রাপ্তা হন রুমী খাতুন। তারপর থেকে বাবার বাড়িতে রয়েছেন তিনি। বাড়িতে একদিন ফিরোজের সাথে মেয়ের পরকীয়া মিলন অবস্থায় দেখে ক্ষুব্ধ হন বাবা নওশের। এক পর্যায়ে এ ঘটনায় ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন তিনি। ওই ধর্ষণ মামলায় আসামী করা হয় মালিগাছা ইউপি চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম শরীফকে। এছাড়া ফিরোজ প্রামানিককে প্রধান আসামী করা হয়। যার মামলা নং ৫০, তারিখ ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ইং।
অপরদিকে ফিরোজের সাথে বিয়ে না হলে আত্মহত্যা করবেন বলে বাবাকে হুমকি দেন রুমী খাতুন। এমন পরিস্থিতির মাঝে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সম্মুখে ফিরোজও রুমী খাতুনকে বিয়ে করার দাবি রাখেন। পরে মালিগাছা ইউপি চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে এবং উভয় পরিবারের সম্মতিতে রুমী ও ফিরোজের বিয়ে হয়। তার বাবার দায়েরকৃত ধর্ষণ মামলাটি যে মিথ্যা এবং সাজানো ছিলো তা নিশ্চিত করেছেন ফিরোজের স্ত্রী রুমী খাতুন। এছাড়া মামলার বাদি রুমীর বাবা নওশের আলী ধর্ষণ মামলাটিও নোটারী পাবলিক হলফনামার মাধ্যমে বিজ্ঞ আদালতকে আপোষ মিমাংসা সম্পাদনার কথা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
এ বিষয়ে মালিগাছা ইউপি চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম শরীফের কাছে ধর্ষিতার সাথে ধর্ষকের বিয়ে কি করে সম্ভব করলেন জানতে চাইলে তিনি জানান, বিষয়টি আসলে ঠিক নয়। ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। মেয়েটাও তালাকপ্রাপ্ত ছিলো। দু’জনের গভীর সম্পর্ক থাকার কারণে একদিন একই ঘরে দু’জন ধরা পড়ে। পরবর্তীতে দুইজনের উভয় পরিবারের সম্মতি ও উপস্থিতিতে বিয়ে হয়। মূলত স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মেয়ের পরিবারের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন ও হয়রানীর অপকৌশল নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মামলার বাদি তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আদালতে হলফনামা দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করেছেন।
রুমী খাতুন জানান, ফিরোজের সাথে তার সম্পর্ক তার চার বছরের। এর মধ্যে ধর্ষণের কোন কিছুই না, প্রেম তো সবাই করে, প্রেম করা তো কোন অন্যায় না। ধর্ষণ মামলাটাই ছিলো সাজানো। তারপরেও যেটাই হোক দুই পরিবার তো মেনে নেওয়ার পরেই আমাদের বিয়ে হয়। উভয় পক্ষ থেকে আমাদের বিয়ে দিয়েছে। আব্দুল আলীম যে সন্ত্রাসী হামলার শিকার তাকেও আমরা চিনি না। তিনি আমার ইউনিয়নের কোন বাসিন্দা না, অথচ কি করে আমার মামলার সহযোগি বলে অপপ্রচার চালানো হলো কার স্বার্থে প্রশ্ন রাখেন রুমী খাতুন।
রুমী খাতুনের বাবা নওশের আলী প্রামানিক বলেন, ফিরোজের পরিবার বিয়ের প্রস্তাব না দেওয়াতে তিনি মামলার পথ ধরেছিলেন। ধর্ষণ মামলা দিয়ে হাসপাতালে মেয়ের ডাক্তারী পরীক্ষা শেষে, মেয়ের আত্মহত্যার হুমকি, অপরদিকে প্রতিবেশিদের কথা ভেবে দেখি মেয়ে তো ঘরে রাখার জিনিস না। তাই আমরা উভয় পক্ষ গত ২৩ ডিসেম্বর বিয়ে দিয়েছি। সন্ত্রাসী হামলার শিকার আব্দুল আলীমকে তিনি চেনেন না বলেও জানান তিনি। পাবনা সদর থানার নুরপুর পাঁচপুকুড় এলাকার দরিদ্র পরিবারের ছেলে আব্দুল আলীম। তিনি মৃত আয়নুল ডাক্তারের ছেলে। তাঁর রাজনৈতিক নেতার ইমেজ ধরে রাখতে গিয়ে পৌরসভার পৈলানপুর টেম্পুস্ট্যান্ড মোড়ে সন্ত্রাসী হামলায় এক যুবক হত্যা মামলার আসামী। তিনি দাবি করেন, হত্যা মামলাটি ষড়যন্ত্রমূলক চক্রান্ত। ঘটনার সময় সে ছিলো না। অনুরূপ আব্দুল আলীমের মামলার প্রধান আসামী মালিগাছা ইউপি চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম শরীফ এর ছোট ভাই আরিফ (৩৮) এর স্ত্রী আজমিরা খাতুন তার স্বামীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে বলে দাবি করেন। আজমিরা বলেন, ঘটনার সময় আমার স্বামীসহ আমরা স্ব-পরিবারে এলাকায় ছিলাম না। আমরা ওইদিন ঢাকায় ছিলাম। আমাদের কাছে গাড়ির টোল প্লাজার রশিদ, বাণিজ্য মেলায় গিয়েছি তার টিকেট, এমনকি যে বাড়িতে আমরা ছিলাম সে বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজও রয়েছে। তাহলে কি করে, কেন, কার স্বার্থে আমার স্বামী আরিফকে প্রধান আসামী করা হলো। আজমিরা তার স্বামী আরিফ এর জন্য প্রশাসনের কাছে ন্যায় বিচার দাবি করেন। এদিকে পুলিশের সামনে আব্দুল আলীম কে মারপিট মামলার প্রধান আসামী আরিফ হোসেনকে গত ২৪ জানুয়ারি শুক্রবার রাতে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এ নিয়ে এ মামলায় এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে এ মামলায় আশরাফুল ইসলাম, তোফাজ্জাল হোসেন ও মিরাজ হোসেন নামের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আলীমের ওপর হামলার ঘটনার সিসিটিভির ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা পুলিশ। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করেছে কমিটি। আর তার প্রেক্ষিতে পেশাদারিত্বের অভাব থাকায় পাবনা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খাইরুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করে জেলা পুলিশ। অপরদিকে আহত আব্দুল আলীম ১৩ দিন হাসপাতালে থাকার পর গত ৩১ জানুয়ারী দুপুর ১২টার পর পাবনা জেনারেল হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তার স্ত্রী রুমা খাতুনের দায়েরকৃত মামলার অভিযোগ সুত্রে জানা যায়, গত ১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় হামলার শিকার হন আব্দুল আলীম। চাঁদার টাকা চেয়ে না পেয়ে তার উপর হামলাকারীরা ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালায় বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ঘটনায় সদর থানার মামলা নং ৬৫, তারিখ ২০ জানুয়ারি’২০২০। এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে একাধিক মাদক মামলার পাশাপাশি হত্যা মামলা রয়েছে। এমন দোষে অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে ধর্ষণ মামলায় পুলিশের সহযোগিতা চাওয়া কতটুকু যৌক্তিক ছিল এমন প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। তারপরও পুলিশ প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে সচেষ্ট হবে বলে প্রত্যাশা সকলের।