মোঃ আব্দুল কুদ্দুস, কুষ্টিয়া প্রতিবেদক: পুলিশ প্রশাসন, আদালত ও প্রসিকিউশনের কিছু পদক্ষেপের ফলে কুষ্টিয়ায় বিচার কাজের গতি আসার পাশাপাশি স্বাক্ষী উপস্থিতি যেমন বেড়েছে তেমনি মামলা নিস্পত্তি বেড়েছে। বর্তমানে মামলা দায়েরের থেকে নিস্পত্তির হার অনেক বেশি। ২০১৮ সাল বা তাদের আগের তুলনায় চলতি বছরে স্বাক্ষী উপস্থিতি যেমন রেকর্ড পরিমান বেড়েছে অন্যদিকে অনেক মামলার রায় হয়েছে এ সময়। এতে বিচার প্রার্থী ও আদালত সংশ্লিষ্টরা সন্তুুষ্ট প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে স্বাক্ষ্য উপস্থিতি ও সময়মতো মামলার সঠিক ও নির্ভুল প্রতিবেদন দাখিলে পুলিশের আন্তরিকতার পলে দৃশ্যপথ বদলে গেছে বলে মনে করছেন অনেকে।
আদালত সুত্র জানিয়েছে, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছরে রেকর্ড পরিমান মামলার রায় হয়েছে। আরো বেশ কিছূ মামলার স্বাক্ষ্যগ্রহণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এসব মামলাও আদালত দ্রুত নিম্পত্তি করতে পারবে। ঘটনা ঘটার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষে আদালতে নির্ভুল প্রতিবেদন দাখিল ও সব স্বাক্ষ্য হাজিরে বিশেষ টিম গঠন করার ফলেই আদালতে বিচারকাজে যে কোন সময়ের তুলনায় গতি বেড়েছে। এছাড়া দায়রাসহ সব আদালতের বিচারকরাও মামলা জট কমাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার প্রার্থীদের সেবা দিতে নিয়েছে নানা উদ্যোগ। একই সাথে প্রসিকিউশন তাদের দায়িত্ব আগের তুলনায় সঠিক ভাবে পালনের কারনেই অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। ধারবাহিক এসব উদ্যোগের উদ্যোগের ফলেই মামলা জট কমতে শুরু করেছে। বিচারধীন মামলাগুলো দ্রুত শেষ করতে পারছে আদালত।
চলতি বছর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন কুষ্টিয়ায় সফরে এসে মামলা নিস্পত্তি ও স্বাক্ষী উপস্থিতি বাড়ায় পুলিশ, বিচারক ও প্রকিকিউশনের কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ দেন। দেশের যে কোন জেলার চেয়ে কুষ্টিয়ায় মামলা নিস্পত্তি ও স্বাক্ষী উপস্থিতি বেশি বলে জানান তিনি।
আদালত সুত্রে জানা গেছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলা নিস্পত্তি ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে কুষ্টিয়ায় পুলিশ, আদালত ও সরকারি প্রসিকিউশন নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করছে। যার ফলে ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছর মামলা দায়েরের তুলনায় নিস্পত্তি অনেক বেড়েছে। চলতি বছর ১৬ হাজার ৯৭টি মামলা দায়ের হলেও ১৭ হাজার ৮৮৬টি মামলা নিস্পত্তি করেছে কুষ্টিয়া জেলা দায়রা জজ ও জুডিশিয়ালসহ সব আদালত মিলিয়ে। দায়ের অপেক্ষা ১ হাজার ৭৮৯টি মামলা বেশি নিস্পত্তি করেছে আদালত। যা অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় রেকর্ড। গত তিন বছরে মামলা নিস্পত্তি হয়েছে ৭২ হাজার ৭৭৫টি। প্রতিটি মামলা যথা সময়ে শেষ করতে স্বাক্ষ্য উপস্থিতি বাড়াতে কাজ করছে স্বারষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত লিগ্যাল এইডের সদস্যরা।
আইআরএসওপি প্রকল্পের জেলা প্রকল্প কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট শ্রাবন্তী মুখার্জী বলেন,‘ মামলা নিস্পত্তি যাতে দ্রুত হয় সে জন্য বিশেষ করে স্বাক্ষী উপস্থিত নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের সদস্যরা বিভিন্ন সংস্থার সাথে কাজ করছে। পুলিশের স্বাক্ষী হলে পুলিশের সাথে যোগাযোগ, চিকিৎসক হলে সিভিল সার্জনের সাথে যোগাযোগসহ পাবলিক স্বাক্ষী হাজির করতে তাদের সাথে আমরা যোগযোগ করি। এমন অনেকে আছেন কবে তাদের স্বাক্ষী আছেন তারা জানেন না। তাদেরকে অবহিত করি আমরা। এরফলে চলতি বছরে রেকর্ড সংখ্যাক স্বাক্ষী আদালতে এসে তাদের বয়ান পেশ করেছে।’
আদালতের আইনজীবীরা জানান, বর্তমান জেলা ও দায়রা জজ অরূপ কুমার গোস্বামী জেলায় যোগ দেয়ার পর বিচার ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তণ হয়েছে। তিনি আসার পর পুরাতন চাঞ্চল্যকর মামলা নিস্পত্তি করার ওপর জোর দেন। তিনি বিচারের সাথে জড়িত সবাইকে নিয়ে কাজ শুরু করে। যার ফলে গত এক বছরেই রেকর্ড পরিমান মামলার রায় দিয়েছেন তিনিসহ তার বিচারকরা। একই সাথে গরীব মানুষ ও আইনি সুবিধা পেতে আর্থিক সামর্থ নেই এমন ব্যাক্তিদের জন্য লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে আইনী সেবার ব্যবস্থা করেছেন।
জেলা পুলিশ প্রশাসন সুত্র জানিয়েছে, বর্তমান পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত যোগদানের পর স্বাক্ষী উপস্থিতিতে গতি পেয়েছে। তিনি আসার পর আলাদা আলাদা তিনটি কমিটি করে দিয়েছেন। একই সাথে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশনা অনুযায়ী সব মামলায় নিশিষ্ট সময়ের মধ্যে চার্জশীট প্রদান করতে নির্দেশনা রয়েছে।
এ কারনে ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছর মামলায় স্বাক্ষী উপস্থিতি ৩৮ ভাগ বেড়ে ৮৭ ভাগে দাঁড়িয়েছে। গত বছর ১৪ হাজার ৮১৩জন স্বাক্ষী উপস্থিত হলেও এ বছর ২২ হাজার ৮১জন স্বাক্ষী উপস্থিত হয়েছে বলে জানাগেছে। তবে আদালত থেকেও স্বাক্ষী হাজিরায় সমন এমনকি ওয়ারেন্ট পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে।
পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত বলেন, ‘আমি যোগদান করার পর প্রথমেই কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছি। যার মধ্যে ঘটনা ঘটার পরপর তদন্ত করে নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে চার্জশীট দাখিল। আর পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি বাইরের যেসব সাধারন স্বাক্ষী থাকে তাদের উপস্থিতি শতভাগ বাড়াতে পক্ষক্ষেপ নিয়েছি। যার কারনে গত এক বছর স্বাক্ষী উপস্থিতি আগের বছরের তুলনায় অনেক বড়েছে। সব থেকে বেশি মামলার রায় হয়েছে এ বছর। আগামীতে শতভাগ স্বাক্ষী উপস্থিত যাতে জয় সে ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হবে।’
জানা গেছে, ২০১৮ সালের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় ৩ জনের মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি ২৫জনের যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছে আদালত। আর চলতি বছরের জুন থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ২৫ জনের অধিক মৃত্যুদন্ড ও শতাধিক আসামীর যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছে আদালত। এছাড়া লিগ্যাল এইড থেকে সেবা পেয়েছেন অসংখ্য গরিব বিচার প্রার্থী মানুষ।
কুষ্টিয়া জজকোর্টের পিপি অনুপ কুমার নন্দী বলেন, ‘মামলায় ন্যায় বিচারের জন্য বিশেষ করে পুলিশের ভূমিকা বড় থাকে। মামলার রহস্য উৎঘাটন, যথাসময়ে চার্জশীট প্রদান তাদের দায়িত্ব। এরপর বিচারক বিচারকাজ শুরু করেন। সেখানে সরকারি প্রসিকিউশনের ভূমিকা রাখতে হয়। তাই তিনটি প্রতিষ্ঠান যখন এক সাথে সমন্বয় করে কাজ করে তখন কাজে গতি আসে। এসব কারনে চলতি বছর প্রচুর মামলা নিস্পত্তি হয়েছে, স্বাক্ষী উপস্থিতি দেশের মধ্যে সেরা। আগামীতে জেলার মানুষকে শতভাগ আইনী সেবা দিতে আমরা প্রস্তুত আছি। এখন পুরাতন মামলা নেই বললেই চলে, এমনকি চলতি বছরের মামলার বিচার কাজ শরু হয়েছে। এতে আদালতের প্রতি বিচার প্রার্থীদের আস্থা বেড়েছে। আর দ্রুত মামলা নিস্পত্তি হওয়ায় সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচাতে পারছে বিচার পাওয়ার জন্য আদালতে আসা মানুষ।’