কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরকে দ্বিখন্ডিত করে বয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী নরসুন্দা নদ। সময়ের পরিবর্তনে নরসুন্দার সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। এককালের ৫৮ কিঃ মিঃ দীর্ঘ এই খরস্রোতা নদটি দখল-দূষণের কবলে পড়ে এখন বুড়িগঙ্গার প্রতিচ্ছবি। যে নরসুন্দাকে কেন্দ্র করে এক সময় গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ শহর, সে নদীটিই এখন বড় নালায় পরিণত হয়েছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলে নদীকে বানানো হয়েছে ভাগাড়। এর ফলে পানির দুর্গন্ধ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে, দু’পাশের ওয়াকওয়ে দিয়ে যাতায়াত করার সময় নাক চেপে ধরতে হচ্ছে। মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে নদীর দুই পাড়ে বসবাসকারী বাসিন্দারা। দূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় শহরবাসী মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। জানা যায়, ৮০ দশকে জেলার হোসেনপুর উপজেলার কাওনা এলাকায় ব্রহ্মপুত্র ও নরসুন্দার সংযোগস্থলে একটি বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে নরসুন্দাকে জেনে-বুঝে হত্যা করা হয়েছে। এর ফলে নদীর নাব্যতা হারিয়ে এখন বর্ষায় জলাবদ্ধতা ও শুষ্ক মৌসুমে চরম দুর্গন্ধের শিকার হচ্ছে শহরবাসী। নরসুন্দা দখলমুক্ত করে খনন করার দাবির প্রেক্ষিতে তৎকালীন কিশোরগঞ্জ-১ (সদর-হোসেনপুর) আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের (এমপি) আন্তরিক প্রচেষ্টায় ২০১২ সালে সরকার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। নরসুন্দা কেন্দ্রিক কিশোরগঞ্জকে আধুনিক শহরের রূপ দিতে ব্যাপক পরিকল্পনা নেয়া হয়। সে অনুযায়ী একই বছরে “নরসুন্দা নদী খনন, পুনর্বাসন ও কিশোরগঞ্জ পৌরসভা সংলগ্ন এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প” নামে একটি প্রকল্প অনুমোদন করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক)। শহরবাসীর স্বপ্নের প্রকল্পটির কাজ উদ্বোধন হয় ২০১২ সালের ২২ নভেম্বর। প্রথম ধাপে ৬৪ কোটি বরাদ্দ করা হলেও দ্বিতীয় ধাপে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ১১৫ কোটি টাকা করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালে কিন্তু ব্যাপক অনিয়ম, লুটপাটের ফলে দুই দফা সময় বাড়িয়ে ২০১৬ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ না করেই চলে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নদী খনন ও পৌরসভা সংলগ্ন এলাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজের মান নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগ স্বপ্নের এই প্রকল্পটিকে গলা টিপে হত্যা করেছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও চিহ্নিত কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি। পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে ৩৩ কিঃ মিঃ খনন কাজের মধ্যে মাত্র ১৫ কিলোমিটার খনন করা হয়েছে। কাওনা এলাকায় দুই নদীর সংযোগস্থলে বাঁধ যেভাবে ছিলো ঠিক একইভাবে থাকার ফলে ব্রহ্মপুত্র থেকে নরসুন্দা বুকে পানি আসেনি। অথচ প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্যই ছিল ব্রহ্মপুত্র থেকে নরসুন্দায় পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনা। নদীর দুই পাড়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্যে সিসি ব্লক দিয়ে পাড় বাঁধাই করা হলেও কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই বিভিন্য জয়গায় ধস নেমেছে। নকশাবহির্ভূত কয়েকটি সেতুসহ একটি মুক্তমঞ্চ, সুউচ্চ নদী পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা মঞ্চের (পরম) প্রতিষ্ঠাতা ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী বলেন, আজ মৃতপ্রায় নরসুন্দা নদী। ৮০ দশকের শুরুতে কাউনায় অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করে নরসুন্দা নদীর প্রাণপ্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে নরসুন্দা নদীকে হত্যা করা হয়। যার ফলে শুকনো মৌসুমে নরসুন্দায় পানি নেই, ভরা মৌসুমে নেই প্রবাহ। ফলে নরসুন্দা নদী পরিণত হয়েছে নোংরা, ময়লা ও আবর্জনার ভাগাড়ে। এ সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাজ বাস্তবায়ন করতে পারলেই নরসুন্দা ফিরে পাবে পানি প্রবাহ। এর মধ্যে কাউনার বাঁধ খুলে মূল ব্রহ্মপুত্র থেকে খাল কেটে নরসুন্দার উৎস মুখে সংযোগ করতে হবে। নদী দখলমুক্ত রাখতে সীমানা নির্ধারণ করে সঠিক পিলার স্থাপন জরুরি। এছাড়াও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাজে সংগঠিত দুর্নীতির তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিচার, সম্পূর্ণ নদী পুঃণ-খননের দাবীসহ যারা নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে দূষণ করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। এদিকে পানির দুর্গন্ধে পরিবেশ দূষণের মাঝেও নদী দখল থেকে নেই। ২০১৪ উচ্ছেদকৃত দু’পাশের জায়গায় নেই সীমানা প্রাচীর ফলে নতুন করে শুরু হয়েছে দখল বাণিজ্যে। ওয়াকওয়ের পাশের জায়গায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। হকারদের একটি সংগঠনের মাধ্যমে দখল করে নেয় হয়েছে উচ্ছেদকৃত জায়গার বিশাল একটি অংশ। মসজিদ নির্মাণের নামেও চলছে দখল। এসবের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কোন নজরদারী নেই বললেই চলে, সামাজিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ জানানোর পরেও প্রশাসন নীরব দর্শক। এ বিষয়ে পৌর মেয়র মাহমুদ পারভেজ বলেন, নদীকে ঘিরে যে স্বপ্নের প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল সেটি শতভাগ বাস্তবায়ন করা হয়নি। অনিয়ম, দুর্নীতির ফলে এ বিপর্যয়ের খেসারত দিচ্ছে শহরবাসী। পৌরসভার উদ্যোগে প্রতিবছর কচুরিপানা ও আবর্জনা পরিষ্কার করা হলেও পানি প্রবাহ না থাকায় স্থায়ী সমাধান করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস থেকে জানা গেছে, নদীতে পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এটি আগামী অর্থবছরে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলী।