আবু তাহের চৌধুরী, সিলেট
সিলেট নগরীর উপকন্ঠ টিলাগড় ইকোপার্কে অবস্থিত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে ৩৩টি প্রাণী ও পাখির মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে প্রাণী ও পাখির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না আদালত তা জানতে চেয়েছেন।গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মুস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন। আইনজীবী ব্যারিস্টার মনোজ কুমার ভৌমিক সুপ্রীম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ সংক্রান্ত রিট আবেদন করেন। সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এসএম সাজ্জাদ হোসেন হাইকোর্টে রুল ও নির্দেশনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।‘প্রাণী ও পাখির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না’-এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টির জবাব আমার কাছে আছে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন আমি যথা সময়ে আদালতে উপস্থাপন করবো।’২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক সিলেটের ডাক-এর প্রথম পৃষ্ঠায় ‘টিলাগড় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র : অযত্ন-অবহেলায় মারা যাচ্ছে একের পর এক প্রাণী’ শিরোনাম’সহ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পরও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এতে প্রাণীপ্রেমীদের মধ্যে দেখা দেয় চরম ক্ষোভ।বন বিভাগের কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে ৪টি ময়ূর, ৪টি হরিণ, ৪টি চুকার প্যাট্রিজ, ২টি বাজিগর পাখি, ১টি অজগর সাপ, ২টি কালিম পাখি, থাইল্যান্ডের ২টি কৈকাপ মাছ ও ১টি খরগোশ ও ১৩টি লাভ বার্ড মারা গেছে কিংবা খাঁচা থেকে পালিয়েছে। তবে, মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি বলে জানিয়েছেন প্রাণীদের তদারকি করেন এমন এক কর্মচারী। তিনি বলেন, মৃত প্রাণীর সংখ্যা ৫০টিরও বেশি হবে। কমপক্ষে আরও ১০টি প্রাণীর কোনো খোঁজ নেই। প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই বছরের মধ্যে এতগুলো প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে অভিজ্ঞ জনবল ও উপযুক্ত পরিবেশের অভাবকেও দায়ী করছেন প্রাণী অধিকার কর্মীরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের নভেম্বরে চালুর পর থেকে একের পর এক প্রাণীর মৃত্যু ঘটছে এখানে। কিন্তু কি কারণে এ সব প্রাণী মারা গেছে- এর কোন সুনির্দিষ্ট কারণ বলতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। তবে, অনেকেরই দাবী অব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনার অভাব ও দায়সারা দায়িত্ব পালনের কারণেই এসব প্রাণীর মৃত্যু ঘটেছে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে দায়িত্বরত বেশ কয়েকজনের দাবী, বনের ভেতরে অবাধে যানবাহন চলাচলের কারণে প্রাণী মারা যাচ্ছে। এছাড়া ছোট খাঁচায় আবদ্ধ থাকায় ও এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এসে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারার কারণেও মারা যাচ্ছে প্রাণীগুলো। তারা জানান, প্রকল্পের শুরুতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া এই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের অবকাঠামো গড়ে তোলারও অভিযোগও উঠেছিল। এমনকি ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর যেদিন প্রাণী কেন্দ্রে আনা হয়, ওই দিন খাঁচাগুলোকে পুনরায় সংস্কার করে প্রাণীদের খাঁচায় প্রবেশ করানো হয়। এসব খাঁচায় প্রাণীদের প্রজনন হচ্ছে বলেও মনে করছেন তারা।সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী অধিকার সংস্থা প্রাধিকারের সভাপতি আহমদ রাফি বলেন, সংরক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনার জঘন্য অবস্থা। প্রাণীগুলোকে খাঁচায় এমনভাবে রাখা হয় যে, সেখানে বাঁচাই সম্ভব না। এছাড়াও, কেন্দ্রের ভেতরে গাড়ি চলাচল করাটা প্রাণীদের জন্য খুবই যন্ত্রণাদায়ক। এ ব্যাপারে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দের সাবেক ভেটেরিনারি পরামর্শক ডা. মঞ্জুর কাদের চৌধুরী বলেন, প্রাণীদের দেখাশুনার জন্য স্থায়ী চিকিৎসকসহ প্রশিক্ষিত জনবল দরকার। যেটা এখানে নেই। প্রাণীদের এখানে আনার আগেই চিকিৎসকসহ জনবল নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এখানে শব্দ, বায়ু দূষণ ও খাঁচায় জায়গা সংকটসহ বিভিন্ন কারণে প্রাণীদের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।তিনি আরও বলেন, এটা ইকোপার্ক নাকি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র এখনো সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। এটা যদি পার্ক হয়, তবে দর্শনার্থী আসার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু, এটি যদি শুধুমাত্র বন্যপাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র হয়। তবে এখানে এতো দর্শনার্থী আসার সুযোগ নেই।বনের ভেতর ২৪ ঘন্টাই অবাধে যানবাহন চলাচল করায় শব্দ দূষণের সৃষ্টি হয়ে প্রাণীদের ক্ষতি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একদিকে দর্শনার্থীদের অবাধ আনাগোনা ও সার্বক্ষণিক যানচলাচলে প্রাণীগুলো শব্দ দূষণে অসুস্থ হয়ে মারা যেতে পারে।’প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালে সিলেট নগরীর পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত টিলাগড়ের পাহাড়-টিলাবেষ্টিত ও ঘন সবুজে আচ্ছাদিত ১১২ একর জায়গায় গড়ে তোলা হয় ইকোপার্ক। এরপর ২০১২ সালের ৩ অক্টোবর মৎস্য ও প্রণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সভায় সিলেট ইকোপার্কে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত এবং ২০১৩ সালের মে মাসে এর নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। ২০১৬ সালের জুনে ৩০ একর জায়গার উপর নির্মিত ওই প্রকল্পের কাজ শেষে কেন্দ্রটি সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার দপ্তরকে হস্তান্তর করা হয়। পরে এটি চালু নিয়েও দেখা দেয় নানা জটিলতা। তবে, ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের শুরুতে দর্শনার্থীদের জন্য এ কেন্দ্রটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। শুরুতে এখানে ঠাঁই পায় ৯ প্রজাতির ৫৮টি প্রাণী। কিন্তু,চালু হওয়ার ১৭ মাসের মাথায় নানা সমস্যার মুখে পড়েছে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র’টি।