চৌহালী, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার বৈন্যা গ্রামে গণহত্যার গণকবর অরক্ষিত জরাজীর্ণ অবস্থায় অবহেলায় রয়েছে। ২ বছর আগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও সীমানা বেষ্টনী প্রাচীর না থাকায় গবাদি পশু অবাধে বিচরণ করছে। ভরে গেছে আগাছাতে। গণহত্যার গণকবরটি যথাযথ সম্মানে সংরক্ষণ না করায় এখানে শুয়ে থাকা ১৪ শহীদদের আত্মা যেন গুমড়ে কাঁদছে। দ্রæত সীমানা বেষ্টনী নির্মাণসহ স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের দাবি শহীদ স্বজনদের। চৌহালী উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের অন্যান্য জায়গার মতো সিরাজগঞ্জের চৌহালীর বিভিন্ন স্থানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৩ যুগ পর একটি গণহত্যার গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। সেটি হচ্ছে চৌহালী উপজেলার খাষপুখুরিয়া ইউনিয়নের বৈন্যা গ্রামে। আজও সেই গণকবরটি পড়ে আছে অযতœ আর অবহেলায়। খাষপুকুরিয়া ইউপির প্রাক্তন চেয়ারম্যান শিক্ষাগুরু মোঃ মিজানুর রহমান, স্থানীয় সংবাদকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় প্রশাসন যাচাই বাছাই করে এ গণকবর চিহ্নিত করেন ইউএনও মওদুদ আহমেদ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের দিকে তৎকালীন ইউএনও দেওয়ান মওদুদ আহম্মদের প্রচেষ্টায় উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের প্রায় আড়াই লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে ১৪ শহীদের নাম সম্বলিত একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। তবে গণকবর ও ফলকটি সংরক্ষণে নির্মান করা হয়নি সীমানা বেষ্টনী। এ কারণে গবাদি পশু বিচরণ করে গণকবরটিতে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করায় আগাছার জন্ম হয়েছে। ডিজিটাল যুগেও এ যেন দেখার কেউ নেই। শহীদদের স্বজন ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর সকালের দিকে বৈন্যা গ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণ হবে এমন খবরে ছড়িয়ে পড়ে এলাকাজুড়ে। ওই সময় মুক্তিকামী জনতা প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জ নিয়ে জৈনক দুলাল সরকারের ফাঁকা বাড়িতে একে একে জড়ো হতে থাকে। কিন্তু স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে বিষয়টি জানাজানি হলে পাক বাহিনী দুলাল সরকারের বাড়িটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। পরে ১৮/২০ জন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও নির্যাতন চালায় হানাদার বাহিনী। পর্যায়ক্রমে ঘটনাস্থলেই নাম জানা না গেলেও ১৪ জন শহীদ চিহ্নিত করে একটি ফলক নির্মাণ করা হয়। এখানে নাম না জানাসহ প্রায় ২০/২২ জনকে গুলি করলেও কয়েকজন বেঁচে যান। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় অন্যত্র নিয়ে যায় তাদের স্বজনরা। ২০০৮ সালের দিকে খাষপুখুরিয়া ইউপির তৎকালীন চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ও শহীদদের স্বজন গণকবরের সীমানা ঠিক রাখতে দুই ফুট উচ্চতার একটি দেয়াল নির্মাণ করেন। এখন তা ভেঙ্গে পড়েছে। বর্তমানে গণকবরটি অযতœ-অবহেলায় পড়ে আছে। স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গণহত্যার শিকার শহীদের স্বজনদের উদ্যোগে ২০১৯ সালের দিকে বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়। পরে তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা দেওয়ান মওদুদ আহম্মদ এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় প্রবীণদের সঙ্গে আলোচনা, তথ্যানুসন্ধান শেষে বৈন্যা গণহত্যা স্মৃতিফলক নির্মাণ করেন। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সীমানা প্রাচীর বা স্থায়ীভাবে গণকবরটি সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায় শহীদ স্বজন ও স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কত জাতীয় দিবস যায় কোন রাখা হচ্ছে না গণকবরে শায়িতদের। চৌহালী প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোঃ মাহমুদুল হাসান বলেন, চৌহালী একটি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অজোপাড়াগাঁ, তাই জনগোষ্ঠীর কাক্সিক্ষত গণকবর চিহ্নিত হয়নি, কালের পরিবর্তন আর স্থানীয় সাংবাদিকদের কলমের খোঁচায় উঠে আসে জনপদের গণহত্যার গণকবর। খাষপুকুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মিজানুর রহমান জানান, আমার বড় ভাই হারুন ও ভগ্নিপতি শাহজাহান এ গণকবরে শায়িত রয়েছে। তাই ৭১ এর সেই ভয়াল দিন ও গণকবরটি ইতিহাসের পাতায় আবদ্ধ রাখতে বারবার ছুটে আসছি প্রশাসন ও মুক্তিযুদ্ধের কাছে। উন্নয়নের ছোঁয়া পেলেও এখনো পূর্ণতা পায়নি তাই প্রশাসনের একজন কামনা করছি। এ বিষয়ে চৌহালী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মজনু মিয়া জানান, বৈন্যা গণকবরটিতে সীমানা বেষ্টনী না থাকায় অরক্ষিত রয়েছে। এতে কিছু আগাছার জন্ম হয়েছে। দ্রæত পরিষ্কার করে স্মৃতিস্তম্ভটি সংরক্ষণে সীমানা প্রচীর নির্মাণে উদ্যোগ নেয়া হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আনিসুর রহমান জানান, সরকারের উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গণকবর ডিজিটালের আওতায় আসবে ইনশাআল্লাহ।