বাগেরহাট প্রতিনিধি : পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দ্রুত এগিয়ে চলেছে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ। একদিকে দীর্ঘদিনের স্বপ্ন হচ্ছে বাস্তব অন্যদিকে দীর্ঘ এক যুগের অপেক্ষার অবসান শেষ হতে যাচ্ছে। স্বপ্নের খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পের কাজ এখন শেষের পথে। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৯৯% কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ৯ নভেম্বর এটি চালু হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ৭৩ বছর পর রেল যোগাযোগের সঙ্গে যুক্ত হবে। বাণিজ্যিক যোগাযোগ সম্প্রসারণে বন্দরকে রেলসেবার আওতায় আনা হচ্ছে। আর একে ঘিরে বাড়বে মোংলা বন্দরের গতিশীলতাও। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি আসবে। তেমনি মোড় ঘুরবে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা।
খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পের ৯৯% শেষ হয়েছে। চলতি মাসেই ট্রেন চলাচলের ট্রায়াল দেওয়া হবে। আগামী ৯ নভেম্বর প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন।
রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯ নভেম্বর খুলনা সফর করবেন। সেদিনই তিনি খুলনা-মোংলা রেললাইন উদ্বোধন করবেন। এর আগে অসমাপ্ত কাজ শেষ হবে। কাজ শেষ করেই খুলনা-মোংলা রেললাইনে ট্রেন চলাচল করবে। গত ১৪ অক্টোবর শনিবার খুলনার মোহাম্মদ নগর রেলস্টেশন পরিদর্শন শেষে এসব কথা বলেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারত সরকারের ঋণ সহায়তা চুক্তির আওতায় খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান লার্সেন অ্যান্ড টার্বো এবং আরেক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল। ২০১০ সালে খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। এরপর এর সম্ভ্যাবতা যাচাই, ডিজাইন চূড়ান্ত, দরপত্র আহ্বান ও ঠিকাদার নিয়োগসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। প্রকল্পটি তিনটি ভাগে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে: প্যাকেজ ১-রেললাইন নির্মাণ, প্যাকেজ ২-রূপসা নদীর ওপর রেলসেতু এবং প্যাকেজ ৩-টেলিযোগাযোগ ও সিগন্যালিং সিস্টেম। এসব প্রকল্পের আওতায় মূল লাইনসহ রেলওয়ে ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য ৮৬ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ। আর রূপসা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচ দশমিক ১৩ কিলোমিটার রেলসেতু। ইতিমধ্যে ওই সেতুর কাজ প্রায় শতভাগ শেষ।
এদিকে, এ প্রকল্পের ৯১ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে বসানো সম্পন্ন হয়েছে ৮৬ কিলোমিটার। এছাড়া ১১টি প্লাটফর্ম, ১০৭টি কালভার্ট, ৩১ ছোট ব্রিজ ও ৯টি আন্ডারপাসের সবগুলোই নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে প্রকল্পের ফুলতলা অংশে পরীক্ষামূলকভাবেও চলেছে রেল। সব মিলিয়ে এখন খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। শেষ পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে রেলপথের ফিনিশিং এবং সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশনের কাজ চলছে।
প্রকল্পটি ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায়ও কাজ বাধাগ্রস্ত হয় বেশ কয়েকবার। পাঁচ দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে এ কাজ শেষ করার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়। অবশেষে এখন কাজ একেবারেই শেষ পর্যায়ে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন ২৫ জুন সপ্তম ও শেষ স্প্যানটি বসে রূপসা রেলসেতুতে। রেলসেতুর ভায়াডাক্টের ৮৫৬টি পাইল বসানো হয়েছে। মূল সেতুর পাইল ৭২টি, পাইল ক্যাপ আটটি, বিয়ারিং ৩২টি সম্পন্ন হয়েছে। সেতুটির উপরিভাগ তৈরি করা হয়েছে স্টিলের গার্ডার এবং আরসিসি ডেকের সমন্বয়ে। এর মধ্যে রূপসা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণ করে লার্সেন অ্যান্ড টার্বো এবং রেল লাইন নির্মাণের কাজ করে ইরকন ইন্টারন্যাশনাল।
সরেজমিনে দেখা যায়, রেলপথের শেষ প্রান্ত মোংলা স্টেশনে শেষ সময়ে ডাম্পিং মেশিনের সাহায্যে রেললাইন সমান করা, পাথর বসানোসহ অন্যান্য কাজে ব্যস্ত নির্মাণ শ্রমিকরা।
ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনালের সুপার ভাইজার গৌতম কুমার জানান, এখন আমরা একেবারেই শেষ সময়ের কাজ করছি। রেলপথ বসানো সম্পন্ন হয়েছে; এখন রেললাইনগুলো ডাম্পিং মেশিনের সাহায্যে সমান করা হচ্ছে; পাথরগুলো এক জায়গায় করা হচ্ছে; লেভেলিং ও রেলের বগির চাপ ঠিকভাবে যেন নিতে পারে সে কাজগুলো করা হচ্ছে। এ পর্যায় শেষ করা গেলেই সেতু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে।
প্রকল্পটির নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাসুম হোসেন বলেন, আমাদের কাজ ৯৯% শেষ হয়েছে। এখন মূলত ফিনিশিং ওয়ার্ক চলছে। এখন রেলপথ গাড়ি চলাচলের জন্যে প্রস্তুত।
খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পের পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ৯ নভেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন বলে আমি আশা করি।
তিনি বলেন, প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় লোন রয়েছে দুই হাজার ৯৪৮ কোটি এক লাখ ৮৪ হাজার টাকা। বাকি এক হাজার ৩১২ কোটি ৮৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা সরকারি ফান্ড থেকে ব্যয় হবে।
মোংলা বন্দরের ব্যবসায়ী এইচ এম দুলাল ও ইকবাল হোসেন বলেন, মোংলা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর হলেও এখানে রেল সংযোগ ছিল না। ফলে বন্দরটিতে অন্যান্য দেশের বড় মালবাহী জাহাজ ভিড়তে আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। বড় বড় জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তো। এতে মোংলা বন্দরের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হত। যদিও মোংলা বন্দরকে রেলসেবার আওতায় আনতে ইতোপূর্বে একাধিক পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমানে দেশের আর্থিক সমৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ সম্প্রসারণে বন্দরকে রেলসেবার আওতায় আনা হচ্ছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি আসবে।
বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি শেখ লিয়াকত হোসেন লিটন বলেন, বন্দরে আমদানী-রপ্তানীর জন্য রেললাইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদে এবং কম খরচে দ্রুত মালামাল বহন করা যায় রেলে। মোংলা বন্দরসহ এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের একটা স্বপ্ন ছিল ‘রেললাইন’, সেই স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমেই বাস্তব হচ্ছে। খুলনা-মোংলা রেললাইন চালু হলে এ অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী হবে।