মঈন উদ্দীন বাপ্পী, রাঙামাটি প্রতিনিধি
পার্বত্য জেলা রাঙামাটিকে বলা হয় রূপ বৈচিত্র্যের শহর। এ রূপ দেখতে হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসে পাহাড়ি এ শহরে। তবে পাহাড়ি এ জনপদটির পর্যটন শিল্পের কোন গতানুগতিক পরিবর্তন না হওয়ায় পর্যটক ভাটা পড়তে থাকে। এ জেলার বড় একটি সমস্যা হলো- অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের ভয়ে কোন উন্নয়ন এখানে সহজে হয় না। দীর্ঘ বছর ধরে স্থানীয় অনেক পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা এ শিল্পের উন্নয়নে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করলের সন্ত্রাসীদের চাঁদার কারণে সফলতার মুখ দেখতে পায়নি। যে কারণে পর্যটকরা হতাশ হয়ে এ অঞ্চল থেকে বিমুখ হয়ে ফিরে যায়। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে এ এলাকায় নিরাপত্তাবাহিনী অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলে সন্ত্রাসীদের আঁতুর ঘর ভেঙ্গে যায়। এ সুযাগে জেলায় কিছু উদীয়মান তরুণ পর্যটক উদ্যোক্তার আবির্ভাব ঘটে। তাদের হাত ধরে গত কয়েক বছর ধরে জেলায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটে। পর্যটকরা এমন সৌন্দর্য দেখতে ছুটে আসছে পাহাড়ি এ জেলায়।
কাপ্তাই হ্রদ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তর মিঠা পানির কৃত্রিম হ্রদ। তৎকালীন সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে কর্ণফুলী নদীর অববাহিকায় বাঁধ নির্মাণ করে। এ বাঁধ থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। সৃষ্টি হয় বিশাল মিঠা পানির মনুষ্যসৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদ। এ হ্রদ থেকে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়, কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ রয়েছে। সরকার এ মৎস্য সম্পদ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে। এ হ্রদ পুরো জেলার সাথে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বাঁশ, কাঠ, কৃষি সবকিছু এ হ্রদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। জেলার অধিকাংশ মানুষের খাদ্যের যোগান দেয় জলে ভাসা জমি থেকে উৎপন্ন ফসল। তবে বর্তমান সময়ে কাপ্তাই হ্রদ আরও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে পরিণত হয়েছে। তরুণ পর্যটক উদ্যোক্তারা কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে এখানে নামিয়েছেন রণতরী অর্থাৎ হাউজ বোট। একটা সময় ভারতের কাশ্মীর নদীতে এ ধরণের হাউজ বোট চলতো। যেখানে পর্যটকরা অবসাদ সময় কাটাতো। বর্তমানে এ হাউজ বোট কাপ্তাই হ্রদ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের হাত ধরে কাপ্তাই হ্রদে কাশ্মিরী স্বাদ নিচ্ছে পর্যটকরা। দেশীয় পর্যটকদের আর কাশ্মীর যেতে হবে না। এইবার নিজের দেশ রাঙামাটিতে কাশ্মিরী ভ্রমণের নেশা কাটাতে পারবে।
এ হাউজ বোটগুলোতে রাত কাটানোর ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি কক্ষ আলাদা। পরিবার নিয়ে সময় কাটানো যাবে। প্রতিটি কক্ষে এসি, বিদ্যুৎ এবং ভুঁড়িভোজের ব্যবস্থা রয়েছে। পুরোদিন এ বোটে ঘুরে কাপ্তাই হ্রদসহ পুরো জেলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
জানা যায়, ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে নতুন উদ্যোক্তা দীপাঞ্জন চাকমার হাত ধরে প্রমোদনী বোট লাইফ নাম দিয়ে কাপ্তাই হ্রদে একটি রণতরী নামে। যে রণতরীকে সবাই হাউজ বোট নামে চেনে। এরপর এ যুবককে আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। পরের বছর শুরুর দিকে নামিয়েছেন আরও দুইটি হাউজ বোট। এরপরই একই বছরে শেষের দিকে নামিয়েছেন আরও একটি বোট। এরপর দুর্দান্ত গতিতে ছুটে চলা।
বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদে বিশাল বিশাল নয়টি হাউজ বোট বা রণতরী দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এই বোটগুলোতে সকল প্রকার আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। প্রতিদিন পর্যটকরা এ বোটগুলো বুকিং দিয়ে রাত পার করছে এবং কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করছে।
প্রমোদনী বোট লাইফের ম্যানেজার মো. মোবারক হোসেন বলেন, আমাদের অধীনে বর্তমানে চারটি হাউজ বোট রয়েছে। প্রতিদিন বুকিং থাকে। কারণ এখন পর্যটক মওসুম। যে কারণে কেউ আগে বুকিং না দিলে বোট পাবে না। অর্থাৎ হাউজ বোট ভাড়া করতে চাইলে আগে বুকিং দিয়ে আসতে হবে। বোটের এ ম্যানেজার আরও বলেন, বর্তমানে রাঙামাটিতে নয়টি হাউজ বোট রয়েছে। এর মধ্যে আমাদের চারটি বোর্ট সাউন্ড প্রুফ এবং ফাইবার দ্বারা তৈরি। বাকী অন্যবোটগুলো কাঠের তৈরি। সেখানে সাউন্ড প্রবেশ করে।
তিনি বলেন, আমাদের বোটগুলো দশ আসন বিশিষ্ট। দশজন পর্যটন আরাম-আয়েশে সময় কাটাতে পারবে। এজন্য জনপ্রতি আমাদের পেমেন্ট করতে হবে সাড়ে সাত হাজার টাকা প্রতি রাত। তবে বন্ধের দিন ছাড়া থাকতে হলে আমাদের দিতে হবে জনপ্রতি সাত হাজার টাকা। তিনি আরও বলেন, আমাদের বোটে সকালের নাস্তা, দুপুরে লাঞ্চ, বিকেলে নাস্তা এবং রাতে ডিনারের ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রমোদনী বোট লাইফের স্বত্ত্বাধিকারী দীপারঞ্জন চাকমা বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে বোটগুলো নামিয়েছি। বর্তমানে ভাল আয় হচ্ছে। পর্যটকরা যথেষ্ট সাড়া দিচ্ছে। রাঙামাটির পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে আমি প্রথমে কাপ্তাই হ্রদে সাহস করে নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে হাউজ বোট নামিয়েছি। এ বোটের মালিক আরও বলেন, আমার দেখাদেখি অনেকে হাউজ বোট নামাচ্ছে। এটা সত্যিই আমার কাছে গর্বের বিষয়। নতুন নতুন তরুণ উদ্যোক্তার সৃৃষ্টি হচ্ছে।
তরুণ উদ্যোক্ত দীপাঞ্জন চাকমা বলেন, সরকার যদি রাঙামাটিকে নিয়ে আরও মহাপরিকল্পনা করেন তাহলে দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধশালী হবে। অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বিদেশে ভ্রমণকারী দেশীয় পর্যটকরা বিদেশে না গিয়ে দেশে ভ্রমণ করবে।