মোঃ হাবিব ওসমান, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি : ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ২নং জামাল ইউনিয়নের তৈলকূপী গ্রামের অধিকতর সংগ্রামী দরিদ্র কৃষক পিতা রেজাউল ইসলাম ও মাতা গৃহিনী আফরোজা বেগম দম্পতির মেধাবী সন্তান সজিব হোসেন শত অভাব ও প্রতিকুলতা মোবাবেলা করে ৪১তম বিসিএস ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে সজিব ছোট। বড় ভাই রাজিব বাবার সঙ্গে কৃষি কাজ করার কারনে লেখাপড়ায় বেশী এগোতে না পারলেও সজিব অভাবের সঙ্গে লড়াই করে আজ সফলতার দ্বারপ্রান্তে। আর্থিক অস্বচ্ছলতা, টিউশনি করা অভাবী সেই ছেলেটি আজ শত বাঁধা পেরিয়ে সদ্য প্রকাশিত ৪১তম বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলার তৈলকূপী গ্রামের অজোপাড়া গায়ের এক নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান সজিবের সংগ্রামী জীবনের গল্প এখন কালীগঞ্জ উপজেলার মানুষের মুখে মুখে। এ প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে গিয়ে অকপটেই সজিব জানিয়েছেন, তার জীবনে নানা চড়াই উৎরাইয়ের কথা। সজিব বলেন, আমার বাবা অল্প কিছু জমি চাষ করেন এবং মা গৃহিণী। প্রত্যন্ত গ্রামে বিদ্যুতের আলোয় পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। হারিকেনের আলোয় মাটির ঘরে পড়াশোনা করতে হয়েছে। তৈলকূপী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতূর্থ শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর বাবার ইচ্ছায় বেগবতি নদির অপর প্রান্তে বারোপাখিয়া দাখিল মাদ্রাসায় ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। মাদ্রাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রত্যেক ক্লাসে ১ম স্থান অর্জন করে শিক্ষকদের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠে। শিক্ষকদের ভালোবাসা আর দিক নির্দেশনায় দাখিল পরীক্ষায় ৪.৯৪ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। এরপর কালীগঞ্জের শহীদ নূর আলী কলেজে ২০১১-১২ সেশনে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয় এবং সেখান থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ৪.৮০ পেয়ে কলেজজীবন শেষ করে।
২০১৩ সালের ভার্সিটি এডমিশন পরীক্ষায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ’ল’ তে ভর্তি হয়ে দুই মাস ক্লাস করার পর সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার (তখন ঢাবিতে ২বার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া যেত)। সিদ্ধান্ত মোতাবেক তার কলেজের মেধাবী ছাত্র সোহাগ এবং হাফিজ নামের দুজন বন্ধুর সাথে ঝিনাইদহে মেসে থেকে আবার নতুন করে এডমিশনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে এডমিশনের জন্য পুর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। এবং সফলতার সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। একই সময়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইটা ইউনিটে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ারও সুযোগ পেয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে অনার্স ২০১৯ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করে একাডেমিক শিক্ষাজীবনের ইতি টানে।
সজিব আরো জানায়, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ করতে গিয়ে আমাকে বিভিন্ন সময়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন আমি যখন মাদ্রাসায় ভর্তি হই তখন আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না, আমি বেগবতি নদীর জন্মলগ্ন থেকে কোন ব্রিজ নেই, বাঁশের একটা সাঁকো পার হয়ে যেতে হয় মাদ্রাসায়। বৃষ্টির সময় সাঁকোটা পানির নিচে ডুবে যেতো তখন তালের ডোঙায় ঝুকি নিয়ে নদি পার হয়ে মাদ্রাসায় যেতে হতো। গ্রামের কাদার রাস্তায় হেটে হেটেই মাদ্রাসায় গিয়েছি। মাদ্রাসায় কারিকুলাম যেমন ইংরেজি ও ম্যাথে বেশ দুর্বল ছিলাম। পরবর্তীতে ঐ দুর্বলতা কাটাতে আমাকে ব্যাপক পরিশ্রম করতে হয়েছিল।
ভার্সিটি এডমিশনের ইংরেজি শিক্ষক ঝিনাইদহের শ্রদ্ধেয় সাইফ স্যারের সহযোগিতায় ইংরেজি ভীতিটা দূর করতে পেরেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে ভর্তি হওয়াটাও আমার জন্য অনেক কষ্টকর ছিল, কেননা আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলনা। ১২-১৫ হাজার টাকা একসঙ্গে যোগাড় করাটা অনেক কঠিন ছিল। আমার মা হাঁস মুরগী পালন করতেন সেখান থেকে জমানো টাকা দিয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বড় ভাই আশরাফুল ইসলাম (বর্তমানে যুগ্ম কর কমিশনার) ও সামাদ ভাইয়ের সহযোগিতায় ভর্তি হয়েছিলাম। এভাবে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হয়। বাবা মায়ের অনুপ্রেরণায় ও সর্বাত্মক সহযোগিতায় এবং নিজে একটা টিউশনি করে আমি অনার্স পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করি। পরবর্তীতে আমার বড়ভাই রাজিব হোসেন, চাচা শেখ ফিরোজ, ডাঃ মাসুদুল হক, দাদা শেখ জহুরুল হক আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। আমার এ খুশির দিনে তারা এবং আমার সকল শিক্ষকদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) আমার ছোট বেলার স্বপ্ন, বিশেষ করে কলেজ জীবনে যখন ইউএনও কে কলেজ ভিজিড করতে দেখতাম তার এটিটিউড আমাকে খুব মুগ্ধ করত, তখন থেকেই ভাবতাম ইস! যদি ইউএনও হতে পারতাম। আল্লাহ আমার ইচ্ছা পূরণ করেছেন ইউএনও হওয়ার জন্য প্রশাসন ক্যাডার না পেলেও শিক্ষা ক্যাডারে বিসিএসের স্বাদটা পান করতে পেরেছি। সিভিল সার্ভিসের একজন ক্যাডার হতে গেলে কতটা পরিশ্রম প্রয়োজন সেটা আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর বুঝেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে, আমি আজীবন শুকরিয়া আদায় করি আল্লাহর দরবারে এত সুন্দর একটা প্লাটটফর্ম আমাকে দেওয়ার জন্য। ৪১তম বিসিএস আমার ২য় বিসিএস কেননা আমি ৪০তম বিসিএসে অ্যাপিয়ার্ড দিয়ে এপ্লিকেশন করেছিলাম। তবে, পড়াশোনা করার পর এটাই প্রথম বিসিএস। এর পরে আমি আরো দুইটা বিসিএস দিয়েছি, ৪৩তম ও ৪৪তম লিখিত ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছি। যেহেতু আমার স্বপ্ন ছিল প্রশাসনে যাওয়ার, এখন সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। শিক্ষা ক্যাডারে অংশগ্রহণ করে আমি আমার অর্জিত জ্ঞান সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। দেশমার্তৃকার সেবায় নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রাখতে চাই। এজন্য সকলের কাছে দোয়া প্রার্থনা করছি।
ব্যক্তি জীবনে আমি ২০২২ সালের আগস্টে বেকার অবস্থায় বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেছিলাম। আমার সহধর্মিনীও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্রী ছিল। আমার এ অর্জনের পিছনে আমার সহধর্মিনীর অবদানও অনেক। সে সবসময় আমাকে অনুপ্রেরণা, শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। আমার উপর আস্থা রেখেই আমাকে বেকার অবস্থায় বিয়ে করেছে।
সজিব বিসিএসে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের বলেন, আমার পরামর্শ হলো সঠিক পরিকল্পনা, সৎ উদ্দেশ্য, পড়াশোনায় পর্যাপ্ত শ্রম দিলে সফলতা আসবেই। টেকনিক্যালি পড়াশোনা করলে অল্পতে বিসিএসে ভাল করা সম্ভব।
একজন গ্রামের ছাত্রের সফলতার বিষয়ে জানতে চাইলে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়রুল আজীম বলেন, কালীগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে একজন ছাত্র উঠে আসা নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার। তার সফলতার জন্য প্রতিভার পাশাপাশি প্রয়োজন ধৈর্য, ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম অবশ্যই প্রসংশনীয়। একজন ছাত্র প্রতিযোগিতামূলক শহরে না থেকেও গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশে থেকে মেধা নিয়ে সফলতা বয়ে আনতে পারে এটিই তার বাস্তব উদাহরণ। সজিব তার বাবা, মা, শিক্ষক এবং এলকাবাসীর স্বপ্ন পূরণ করেছে। আমার বিশ্বাস তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার সহযোগিতা হিসাবে অবদান রাখবে। এই সফলতায় ঝিনাইদহ-৪ তথা পুরো কালীগঞ্জের মানুষের মুখ উজ্জল হয়েছে বলে জানান তিনি।